রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে একুশে বইমেলা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল যে আন্দোলনের মাধ্যমে, তা ছিল ভাষা আন্দোলন। বাঙালি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য অর্জন যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক ঘটনাও কম নয়। এরই মধ্যে দেশের সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য একটি মাইলফলক একুশে বইমেলা। বইমেলা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। উনিশ শ একাত্তর সালের পনেরো ফেব্রুয়ারি একুশের স্মরণে প্রথম সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বাংলা একাডেমিতে। তখন প্রধান অতিথি হিসেবে সেই মেলার উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই বিশালসংখ্যক পাঠককে যে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করছে, এটা বইমেলার বড় একটা অবদান। এ ছাড়া ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে একটা লম্বা সময় ধরে ভাষাকেন্দ্রিক এই মেলা চলাটা বড় ব্যাপার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে বইমেলা হয়তো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে উঠতে পারেনি, যেমনটা হয়েছে কলকাতা বইমেলা। কিন্তু বাংলাদেশের পাঠককে পশ্চিমবঙ্গের বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাংলাদেশের বইয়ের দিকে মনোযোগ ফেরাতে খুব সাহায্য করেছে একুশে বইমেলা। প্রতিটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগৎ বা লাইব্রেরি। একই সাথে দেশের সব মেধার সংগ্রহশালাও হচ্ছে এই লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে।

এতে এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার চলে আসে সবার হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবনিতা এই বিশাল জ্ঞান-সমুদ্রের সাথে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ পায়। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির নিজ নিজ ভাষা আছে। সব ধরনের ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে তারা তাদের নিজেদের ভাষায়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষায়, ইংরেজরা ইংরেজিতে, চায়নিজরা চায়নায়, ভারতীয়রা হিন্দিতে এবং এভাবে অন্য সব দেশের লোকেরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে থাকে। এগুলো তাদের মাতৃভাষা আর মাতৃভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে বোঝানো হয়, যা কোনো শিশু তার জন্মের সময় থেকেই পেয়েছিল। আমরা কথা বলি, শুনি, মিথস্ক্রিয়া করি, মনের আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করি এবং হাসি-কান্না ও দুঃখণ্ডবেদনা সবই প্রকাশ করি আমাদের নিজস্ব ভাষায়, আর তা-ই হচ্ছে বাংলা ভাষা, মানে আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও সম্মানিত একটি ভাষা, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভাষা যোগাযোগের এমন একটি ব্যবস্থা, যা একগুচ্ছ শব্দ এবং লিখিত প্রতীকের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের লোকেরা কথা বলতে বা লেখার জন্য ব্যবহার করে। মাতৃভাষা আসলে সেই ভাষাটি, যেখানে কোনো শিশু কোনো শব্দ বুঝতে শুরু করার আগে তার সঙ্গে কথা বলে। এটি এমন একটি প্রভাবশালী ভাষা, যা প্রকৃতপক্ষে একজন ব্যক্তির চিন্তাধারাকে সংজ্ঞায়িত করে। মোট কথা, একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর থেকে যে ভাষায় কথা বলে, শোনে, মনের আবেগ ও অনুভূতি ব্যক্ত করে তা-ই মাতৃভাষা। শিশুর বিকাশে মাতৃভাষার ভূমিকা অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ। এটি আরো সুপরিচিত যে একটি শক্তিশালী মাতৃভাষার ফাউন্ডেশন শিশুদের অতিরিক্ত ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে সজ্জিত করে এবং তাদের ভাষার কাঠামো বোঝার জন্য কয়েকটি নতুন ভাষায় স্থানান্তর করতে শেখায়।

শিশুরা যখন তাদের প্রথম ভাষা শিখবে, তখন ব্যাকরণের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো বোঝার ক্ষেত্রে তা সহজেই অন্যান্য ভাষায় স্থানান্তর করতে পারবে। মাতৃভাষা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। প্রথম ভাষায় শক্ত ভিত্তিযুক্ত শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের মধ্যে এবং সমাজের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে আরো গভীর উপলব্ধি প্রদর্শন করে এবং পাশাপাশি মঙ্গল এবং আস্থা অর্জনের বোধশক্তি বৃদ্ধি করে। স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের শিক্ষাগত কৃতিত্বসহ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রবাহিত হয়। অতএব, মাতৃভাষা শিক্ষা এমন শিক্ষাকে বোঝায়, যা শিশুরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। শিশুরা ঘরে বসে যে ভাষায় কথা বলে তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই ভাষা যদি স্কুলে পড়ানো হয়, তবে বোঝা এবং শেখা সহজ করে তোলে। সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মোট কথা, মাতৃভাষা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জীবন্ত প্রতীক। মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত সম্মান এবং বিভিন্ন জাতিগত পটভূমি গঠনে সবার জন্য সমান সুযোগ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে যদি কোনো ব্যক্তি মাতৃভাষায় পারদর্শী হয়, তবে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ এবং কথাবার্তা আরো সহজ হয়ে যায় এবং বিশ্বের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন দুর্দান্ত ধারণা বিকাশ করা সহজ হয়ে যায়। সুতরাং শিক্ষায় মাতৃভাষার যে গুরুত্ব রয়েছে, তা আমরা ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেসকোর জেনারেল কনফারেন্সের একটি ঘোষণার মাধ্যমে বুঝতে পারি। ওই ঘোষণার পর ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলা ভাষার সম্মানে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপিত হয়ে আসছে।

আধুনিক বিশ্বে এখন মেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সবাই। মেলা প্রয়োজনীয়- এই বিবেচনা থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র আজকাল মেলার আয়োজন করে। আর সেসব মেলায় ভিড় করে লাখ লাখ মানুষ। কেউ শুধু দেখতে যায়, কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে, আবার কেউ হয়তো যায় মেলা থেকে নিজের ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র কিনতে। আসলে মেলা সারা পৃথিবীতেই খুব জনপ্রিয়। বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। সারা বিশ্বে এখন বইমেলা হয়। সেসব মেলায়ও লাখ লাখ মানুষের ভিড়। যদিও বই আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মেলার কথা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু যখন বইয়ের প্রচার-প্রসার এবং এর সংগ্রহ শুরু হলো, সেই সময় থেকেই বইয়ের একটা বাজার সৃষ্টি হয়। বইমেলার ধারণাটা অবশ্য আরো পরে এসেছে। প্রাচীন চীনারা বই সংগ্রহ শুরু করে ৯৬০ সালের পরে। তারা এর নাম দেয় ‘শানবিন’। বইকে তারা খুবই গুরুত্ব দিত। তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যই বই সংগ্রহ শুরু করে চীনারা। পৃথিবীতে এই বই সংগ্রহের রীতিটি বেশ আগের-সক্রেটিসের আমলেও বই সংগ্রহের রীতি ছিল। বইমেলা শুরুর পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া- এই ইতিহাস কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়, ৫০০ বছর আগের কথা। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। বলা হয়, সে সময়ই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে। অনেকের মতে, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়েছিল। কিন্তু কারো কারো ধারণা আলাদা। তারা মনে করে, প্রথমে বইমেলা শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় ওটার নামই লোকজন জানত বেশি। তখন বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয় না হলেও পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সতেরো শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরো কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়। সারা বিশ্বে এখন অনেক আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়। সেখানে লোকজনের ভিড়ও দেখার মতো।

তার মধ্যে অন্যতম বইমেলাগুলো হলো- লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলা, নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক বইমেলা, কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি। আমাদের দেশেও অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা হয়। বইমেলা অর্থ বইয়ের মেলা বা বই নিয়ে যে মেলা। অর্থাৎ বই-ই হয়ে ওঠে এ মেলার মূল উপকরণ, উপস্থাপনা ও নির্ভরতার বস্তু। তবে বিষয় বা বস্তুনিষ্ঠতা বইয়ের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম নয়, বই জীবন-জিজ্ঞাসা ও আত্মিক পিপাসা নিবৃত্তির তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণের সন্নিবেশ। তাই অন্যান্য যে কোনো মেলার সাথে এর তুলনা বা সাদৃশ্য চলে না। কথায় বলে, বোবার কোনো শত্রু থাকে না। কিন্তু আমরা দেখি শুধু বাকশক্তি ছাড়া আর সবকিছুতেই তা থাকে, বরং পরোক্ষভাবেই থাকে। তেমনি বই হচ্ছে নীরব বন্ধু। মিত্রত্ব ছাড়া এর শত্রু হওয়ার কোনো শক্তি, সামর্থ্য ও কূটকৌশলতার সুযোগ থাকে না। তাই একখানা পছন্দের বই সঙ্গে থাকলে মানুষ কখনো নিঃসঙ্গ হয় না। বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে তা হতাশা, আলস্য অবসন্নতা ও দুশ্চিন্তা মুক্তির অনন্য অবলম্বন হতে পারে। একটি ভালো বই বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর ভাবনায় আচ্ছন্ন বা ব্যস্ত রাখার সার্থক ভূমিকা নিতে পারে। বই মানুষের নিজ নিজ স্বতন্ত্র সাধনা, ভাব ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ আর অন্তরে ধারণ করার সুযোগ দেয়, যা অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের নির্বাক সাক্ষী হয়ে থাকে। তাই তা মহাকালের লৌকিক সেতুবন্ধে শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন জগতের নান্দনিক দর্শনের সঙ্গী হয়। বই আমাদের প্রয়াত বিখ্যাত মনীষীদের নিঃশব্দ উপস্থিতি ও পরিচয় মেলায়। ফলে সুন্দর ও শিক্ষান্বেষু জীবন গঠনে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোল যদি কেউ এমন করে বেঁধে রাখতে পারতো যে, ঘুমিয়ে পড়া শিশুটির মতো চুপ করে থাকত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সাথে বইয়ের তুলনা হতো।

যেখানে নীরব ভাষার স্থির প্রবাহ মানবাত্মার অমর আলোকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খল বুননে কাগজের সীমানায় বাঁধা পড়ে থাকে। শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, তেমনি বইয়ের মধ্যে হৃদয়ের আবেদন ও আবেগি উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়। এখানেই যেন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় এক পাড়ায় পাশাপাশি বাস করে। সংশয়-বিশ্বাস, কৌতূহল-আবিষ্কার একই দেহের অঙ্গ হয়ে মিশে থাকে। সুতরাং বই কোনো আনুষঙ্গিক অনুষঙ্গ ছাড়াই নির্ভরশীলতার এক আস্থাশীল আশ্রয়।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close