ইসরাত জাহান

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

মুক্তমত

নিলামের দুয়ারে মনুষ্যত্বের হানা

লতাপাতা গায়ে জড়িয়ে, গুহায় রাত কাটিয়ে সময় অতিবাহিত করা মানুষগুলো ধীরে ধীরে পা দিলো সভ্যতার গণ্ডিতে। যতই দিন যাচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়া যেন অনেক অসম্ভাবনার দুয়ারে সম্ভাবনার ডাক দিচ্ছে। এই আধুনিকতার ছোঁয়া যতই লাগছে যেন মানুষ তার মনুষ্যত্বকে চাপা দিয়ে অমানুষিকতাকে সাঙ্গ করে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে মানুষ যেন ভুলতে বসেছে একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয়কে। প্রতিদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে এমন কিছু ঘটনা পরিলক্ষিত হয় যা মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়।

সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমান সময়ের খুবই পরিচিত একটা শব্দ। রোজ সকালে সূর্য উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নতুন একটি দিন। নতুন দিনে নতুন আশা বুকে নিয়ে মানুষ বেরিয়ে পড়ে কর্মব্যস্তময় জীবনের দিকে। নিরন্তর ছুটে চলে। আর এই ছুটে চলার মাঝেই হঠাৎ করেই নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়। চোখের পলকেই নিভে যায় এক তাজা প্রাণ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরণ করে নিতে হয় মৃত্যুকে। রোজ গণমাধ্যমে উঠে আসে এ রকম অনেক ঘটনা। পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায় স্বজন হারানোর ব্যথায় ব্যথিত অন্য স্বজনদের আহাজারি। এই আহাজারি যেন থামার নয়। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর মা-বাবা, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কা এ রকম অনেক সংবাদ পরিলক্ষিত হয়। এভাবে সড়কে বেঘোরে মৃত্যু কখনো কাম্য নয়। কথায় তো বলে ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’। যখন একটি জীবন প্রদীপ নিভে যায় তখন ওই পরিবারে যে অন্ধকার নেমে আসে তা ওই পারিবারকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। অনেক পরিবারের সুখের প্রদীপটাই নিভে যায়। অনেক সময় দেখা যায় দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তি অনেক সময় ধরে সড়কে পড়ে থাকে অথচ তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথচারী দেখেও না দেখার ভান ধরে ছুটে চলে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় যেন তার বিবেক ঘুমিয়ে থাকে। একজন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত হলে কোনো ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরে তখন দেখা যায় আরেক হৃদয়ে নাড়া দেওয়া ঘটনা। অনেক সময় ডাক্তাররা তাকে চিকিৎসা দিতে গড়িমসি করা শুরু করে দেয়। তাদের ভাষ্য মতে, আইনি পদক্ষেপের পরে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব। এতে করে অনেক সময় মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে থাকা মানুষটা একটা সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয় মানবিকতা। জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া মানুষটা হয়তো জীবনের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটাই করে, কোথায় হারিয়ে গেল আজ মানবিকতা?

‘জন্মেছিলাম আমি মানুষ হয়ে। কিন্তু জন্মই আমার আজন্ম পাপ’- যে মানুষটার জীবন প্রদীপ নিভে গেল অন্য মানুষের রোষানলে পড়ে হয়তো এটা তার জীবনের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে বলা কথা। রোজকার ঘটনাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেই দেখা যায় ভাই-বোনের হাতে ভাই-বোন, সন্তানের হাতে বাবা, বাবার হাতে সন্তান খুনের ঘটনা। এই তো গত কয়েক দিন ধরে একটা খবর নজর কাড়ল সবার। জামাতাকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকে খুন করেছিল বাবা। যে বাবার কাছে সন্তান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে সেই বাবার হাত রাঙিয়ে দিল নিজের সন্তানের রক্ত। আবারও প্রশ্নবিদ্ধ মানবিকতা। মানুষ হয়েও মানুষকে ভক্ষণ করায় মেতে উঠেছে যেন এক শ্রেণির মানুষ। হিংস্রতা জায়গা করে নিয়েছে তাদের মধ্যে। তারা যেন ভুলে গেছে তারা মানুষ। পশুর চেয়েও অধম বলা যায় তাদের। এসব সন্তানের জন্য আফসোস করতে থাকে তাদেরই বাবা-মা। অনেক সময় সন্তানের কুকীর্তির জন্য সমাজের মানুষের মুখে শোনা হাজারো প্রশ্ন সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় বাবা-মা। সমাজে এমন অনেক মানুষরূপী কীট দেখতে পাওয়া যায় যাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে কিছু মানুষ। একটা মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হাজারো প্রশ্নের, হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কেউ কেউ সেই সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারলেও কেউ কেউ নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় মৃত্যুর হাতে। তখনো হয়তো তারা এই প্রশ্নই করে, কোথায় মানবিকতা, কোথায় মনুষ্যত্ব?

মনুষ্যত্বকে নিলামে তুলে সভ্যতার গান গেয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে এই মানবসমাজ। মানুষরূপী অমানুষ সমাজে বিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠে ধীরে ধীরে এই মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই মনুষ্যত্বের গুণগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করা উচিত। কথায় তো বলে, ‘যদি মানুষ হতে চাও, যদি জীবনে সার্থকতাকে নিয়ে আসতে চাও তাহলে মানবিকতাকে বুকে ধারণ করে নাও’। নিজের জন্য নয় অপরের জন্য বেঁচে থাকাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী

ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close