ওসমান গনি

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

জাতির জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক- কিশোর গ্যাং

বর্তমানে দেশে ও জাতির অপরাধ জগতের একটি মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হলো কিশোর গ্যাং। যে গ্যাং বাহিনীর নাম শুনলে দেশের মানুষের মনে একটি ঘৃণাভাব চলে আসে। তারা নিজেরা নিজেদের কে দেশের বড় মানের একটা কিছু ভাবে। আসলে তারা যে দেশ, জাতি বা মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘৃণার পাত্র তা তারা বোঝে না। তাদের মধ্যে বোঝার মতো সেই শক্তি বা জ্ঞান গড়ে ওঠেনি। তাদের কে কিশোর গ্যাং বানানোর পেছনে একটি অদৃশ্য শক্তি রয়েছে। যারা সেই শক্তিকে বড় ভাই হিসেবে জানে বা মানে। কথিত এ ভাইরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এ বাহিনীকে ব্যবহার করে থাকে। বড় ভাইদের শেল্টার পাওয়ার কারণে তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ঘটাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অঘটন। যারা এ কাজগুলো করছে, তাদের কারো বয়স ১৮ বা কারো কম। পাড়ায়-মহল্লায় চলাফেরা করে দলবেঁধে। সেসব দলের আবার ভিন্ন ভিন্ন নামও আছে। ‘ডিটিসিবি স্ট্রিট’, ‘জল্লা মিলন গ্রুপ’, ‘রোমান্টিক গ্রুপ’...। এ পর্যন্ত তবু উল্লেখ করা গেল, কিছু নাম তো রুচিতে পর্যন্ত বাধে বলে বলা যায় না। বেশবাস ওদের যেমনই হোক, আচার-আচরণে হিরোইজম ভাব। হরহামেশাই ইভটিজিংয়ের শিকার কিশোরী-তরুণীরা ওদের দেখলে আঁতকে ওঠে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওদের পেরিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে! এসব দলকে বলা হয় কিশোর গ্যাং। রাজধানীসহ সারা দেশে রয়েছে এদের অবাধ বিচরণ। চুরি, ছিনতাই, লুট, ডাকাতি এমনকি চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ওদের দৌড়। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাঁয়তারা তো রয়েছেই, ওরা এখন জড়িয়ে যাচ্ছে মাদক কারবারেও। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে খুন-খারাবি। সময় যত যাচ্ছে, এসব কিশোর গ্যাং ততই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বয়স কম হওয়ায় সাজা কম; এমনকি আইনেও অনুকম্পা মেলে। তাতে বরং ওদের বাড় বেড়ে গেছে। সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ দলগুলো আবার ছায়া দিচ্ছে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা, ক্ষেত্রভেদে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারা। উপরন্তু জুটেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়াও। শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করার মধ্যবর্তী সময়কে কিশোরকাল বলা হয়। কোনো কোনো গবেষক ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সি একজন মানুষকে কিশোর বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় ছেলেমেয়েদের শরীর ও মনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের মনে সৃষ্টি হয় নানা কৌতূহল, অজানাকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। স্বাধীনভাবে চলাফেরার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। আপনজনদের কাছ থেকে স্নেহ, আদর ও যত্ন পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। তারা এ সময় বড়দের মতো আচরণ করতে চেষ্টা করে। নিজেকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রকাশ করতে অস্থির হয়ে ওঠে। নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তারা খুব সহজেই আবেগতাড়িত হয়ে যায়। বীরত্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাদের আগ্রহ বেড়ে যায়।

সারা দেশে এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সাধারণ মানুষ তো বটেই; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অনেক সময় ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না উল্টো বিপাকে পড়ার আতঙ্কে। আবার অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদও দিচ্ছে এসব গ্যাংকে। সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন শহর, অলিগলিসহ পাড়াজুড়ে কিশোর গ্যাং এখন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত ২৩ অক্টোবর মধ্যরাতে মিরপুরের পল্লবী সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকার একটি ভবনে হানা দেয় একদল কিশোর, তরুণ ও যুবক। ভবনের ৫ তলার একটি ফ্ল্যাটে ঢুকে নির্যাতন করা হয় দুই প্রবাসীর স্ত্রীকে। ওয়ারড্রোব-আলমারির তালা ভেঙে লুটে নেওয়া হয় নগদ প্রায় ৩ লাখ টাকা ও বিপুল স্বর্ণ ও রুপার অলঙ্কার। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুরের পল্লবীর সি-ব্লকে চলে কিশোর গ্যাং রমজান ও আল-আমিন গ্রুপের তাণ্ডব। চাকু দিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী রাকিবকে উপর্যুপরি আঘাত করে গ্যাং দুটির সদস্যরা। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেও অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার। এমনকি সাহায্য ছাড়া এখন আর হাঁটাচলাও করতে পারেন না রাকিব। কিন্তু ঘটনায় অভিযুক্তরা এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে জামিনে। এখন মামলা তুলে নিতে ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রাকিবের বাবা আবদুল্লাহর।

মিরপুর এভিনিউ-৫ এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী পাপিয়া আক্তার সম্প্রতি মিরপুরের কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়কের দপ্তরে। অভিযোগে পাপিয়া উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন ধরে কিছুসংখ্যক কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব মিরপুরবাসীর জনজীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। তারা ছিনতাই করে, ইয়াবা বিক্রি করে, গাঁজা বিক্রি করে, রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের সময় তাদের থেকে ছিনতাই করে এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া মেয়েদের ইভটিজিং করে। তারা মোবাইল ছিনতাই করে এনে এখানে বিক্রি করে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর সকালে মাদক বিক্রির সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মানা করলে তারা প্রতিবাদকারীর হাতের মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে যায়। পরে মোবাইল আনতে গেলে আমার গায়ের ওড়না টান দেয়। কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রতিদিন একত্রে হয়ে মাদকদ্রব্য বেচাকেনা করে। কেউ বাধা দিতে এলে গায়ে হাত তুলতে আসে; বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধমকি দেয়। যার কারণে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না। এমনকি তারা অস্ত্রও বিক্রি করে।

জানা গেছে, রাজধানীর পল্লবীতে ব্যবসায়ী সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় কিশোর গ্যাং ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা কিছু দিনের জন্য গা-ঢাকা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান থেকে বাঁচতে কেউ কেউ পাড়ি জমায় বিদেশে; কেউ আবার দেশের বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপন করে। কিন্তু মাস কয়েকের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া বেশিরভাগ আসামি জামিন পেয়ে যায়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান থিতিয়ে পড়ায় ফিরতে শুরু করে আত্মগোপনে থাকা অপরাধীরাও। একজোট হয়ে এখন মিরপুর-পল্লবীর বিভিন্ন এলাকায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব অপরাধী। পুলিশের মিরপুর বিভাগের পল্লবীসহ ৭টি থানায় চিহ্নিত যে ২৩টি গ্যাংস্টার গ্রুপ রয়েছে, বিদেশে বসে তার অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের নির্দেশে চাঁদাবাজি-দখলবাজি ছাড়াও মাদক ও গ্যাং কালচারের আধিপত্য ধরে রাখতে অস্ত্র নিয়ে যার-তার ওপর হামলে পড়ছে গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, গত কয়েক সপ্তাহে থানা এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় সন্ত্রাসীদের কোপাকুপিতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। কিছু ঘটনা ঘটেছে পুলিশের সামনেই। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও গ্রেপ্তার নেই বললেই চলে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ বি-ব্লক এলাকায় স্থানীয় কিশোর গ্যাং অনিক বাহিনীর হামলায় আহত হয় সরকারি প্রগতি উচ্চবিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশিক। এই ঘটনায় মামলা করায় তিন দফায় আশিকের পরিবারের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এছাড়াও গত দুই সপ্তাহে পল্লবীতেই কিশোর গ্যাংয়ের কোপাকুপিতে আহত হয়েছেন অন্তত ৪ তরুণ-কিশোর। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ অভিযুক্তরাই রয়েছেন অধরা। কিশোরদের একত্রিত করে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী এলাকার প্রভাবশালী কথিত বড় ভাইয়েরা তাদের বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের ভাড়ায় খাটিয়ে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করাচ্ছে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। আমাদের দেশে শিশুদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব-পালন করছে না। আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ালেও এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোরদের বিপথগামিতা থেকে ফেরানো অসম্ভব বলেও মনে করেন দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। এটি হলো কিশোর গ্যাং তৈরির একটি দিক। অন্য আরেকটি দিক হলো আমাদের দেশে শিশুদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয় এবং অদূর ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আরো কষ্টকর হয়ে পড়তে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close