ডা. মো. ফখরুল আবেদীন
দৃষ্টিপাত
আসুন কুষ্ঠমুক্ত বিশ্ব গড়ি
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসেবে আজ এ বছর ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। কুষ্ঠ রোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘এখনই কাজ শুরু করি, কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করি’।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এন্টি-লেপ্রসি অ্যাসোসিশেয়নসের (আইলেপ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠ রোগবিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ও কুষ্ঠ রোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৪ সালে দিবসটি উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী সংগঠনসমূহের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’, যা ১৩টি আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত, এ দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেয়।
এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা। জনবচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সর্বপ্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, এসব লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা প্রদান করাই হচ্ছে এই দিবসের লক্ষ্য।
বাংলাদেশে এই বছর ওই দিবসটি পালনের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কুষ্ঠ সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানবসভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একেবারেই কমে এসেছে।
১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠ রোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রী’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয়, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠ রোগ ও কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচ্যুত করা হতো। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যেত। হাজার হাজার কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো। প্রায় সব ধর্মে কুষ্ঠ রোগ নিয়ে অনেক কিছু রয়েছে। হাজার বছরের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, অনেক রোগী সামাজিকতার ভয়ে যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে দেরি করে এবং ভয়াবহতা ডেকে আনে।
কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা, কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা বিনা মূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে রয়ে গেছে। মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি) প্রবর্তনের পর থেকে বিশ্বে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আশির দশকে যেখানে বিশ্বে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ছিল ৫২ লাখ, তা এখন দুই লাখে নেমে এসেছে। তবে যে বিষয়টি এখনো যথেষ্ট উদ্বেগের তা হলো, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে নজর দিলে দেখা যায়, প্রতি বছর দুই লাখের ওপর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর ৫৬ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে ভারতে। এরপর একাধিক্রমে রয়েছে ব্রাজিল (১৩.৬ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়া (৮.৫ শতাংশ), নেপাল (১.৯ শতাংশ) ও বাংলাদেশ (১.৮ শতাংশ)। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজারের মধ্যে ছিল। বিশ্বে কুষ্ঠে আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০ লাখ রোগী শনাক্তকরণের অপেক্ষায় আছে, যাদের দক্ষ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত জোগানের অভাবে এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিএলএমআই-বি) মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় ৮-১০ শতাংশ সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরে পঙ্গু হয়ে যায়। ২০১৯ সালে কুষ্ঠ রোগী ছিল ৩২১৬ জন। ২০২০ সালে ছিল ২৭২৪ জন। জাতীয় কুষ্ঠ রোগ নির্মূল কর্মসূচি দেশের ১২ জেলাকে কুষ্ঠ রোগের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো- রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী ও গাইবান্ধা; রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলা; খুলনা বিভাগের মেহেরপুর জেলা; সিলেটের মৌলভীবাজার এবং পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি লাখে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠ রোগী পাওয়া গেলে তাকে উচ্চঝুঁকি বলতে হবে। এ অনুযায়ী এই ১২ জেলা কুষ্ঠ রোগের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন সংক্রামক ধরনের রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়।
চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠ রোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
বিকলাঙ্গতাই হচ্ছে কুষ্ঠজনিত সব সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার প্রধান কারণ। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসায় আসা অতীব জরুরি প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য। কুষ্ঠ রোগ প্রাথমিকভাবে পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় আসলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমাদের দেশে কুষ্ঠের বিশেষায়িত সেবা খুবই অপ্রতুল। কুষ্ঠ রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে তিনটি সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালগুলোর পূর্ণাঙ্গ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্ততপক্ষে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে কুষ্ঠ সেবা প্রদানের জন্য উপযোগী করা দরকার। এতে করে স্থানীয় লোকজন এই সেবা সহজেই নিতে পারবে।
সব ধরনের বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন করা দরকার, যাতে তারা সক্রিয়ভাবে কুষ্ঠসেবার বিষয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের জন্য জীবিকা অর্জনে সাহায্য করা দরকার।
কুষ্ঠ বিষয়ে গণমাধ্যমের ইতিবাচক বার্তা প্রচার এই রোগ নির্মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। কুষ্ঠ রোগ জীবাণু দ্বারা হয়, অভিশাপ নয়। নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে এই রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় বার্তা প্রচার করা উচিত। কোথায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সে বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত বার্তা এই রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কুষ্ঠ বিষয়টা যেন গুরুত্ব পায় সে বিষয়েও গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত।
আমাদের একযোগে অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য কাজ করতে হবে। কারণ এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত রেখে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর পুনর্বাসন এবং সঠিক যত্নের জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। যেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিপূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীরা দেশের বোঝা নয়, তাদেরও রয়েছে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার।
আমাদের জাতীয় সংবিধানে প্রতিটি নাগরিক এর সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকারকর্মীরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনের সাম্প্রতিক ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কুষ্ঠ আমাদের জাতীয় দুর্ভোগের কারণ। আসুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে কাজ করি এবং ভবিষ্যৎ কুষ্ঠমুক্ত বিশ্ব গড়ি।
লেখক : ডিস্ট্রিক্ট স্যার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার
সিভিল সার্জন অফিস, কুমিল্লা
"