ওসমান গনি

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩

বিশ্লেষণ

আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার

প্রতিটি মানুষের জীবনচলার পথ কণ্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এতে রয়েছে হতাশা, চড়াই-উতরাই ও বাধা-বিপত্তি। জীবনে খারাপ সময় আসতেই পারে। ভুলে গেলে চলবে না রাতের পরেই দিন আসে। প্রয়োজন ধৈর্য ও নিজেকে ভালোবাসা। কিন্তু জীবনে একের পর এক ব্যর্থতায় অনেকেই ভেঙে পড়েন, মানসিক যন্ত্রণায় একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আত্মহত্যা একটি মানসিক রোগ। এ রোগটি মানুষকে তার জীবনের নির্দিষ্ট সময়ের আগে ধ্বংস করে দেয়। যারা আত্মহত্যা করে থাকে তাদের ধ্যান-ধারণা এমনই যে, আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিলেই হয়তো তারা বাঁচল। আসলে জিনিসটি কিন্তু এমন নয়।

সম্প্রতি দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়ছে বলে সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। আত্মহত্যার প্রবণতার হার কম-বেশি থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জ্ঞান না থাকা। যাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান আছে, তারা কখনো আত্মহত্যা করে না। তাছাড়া ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্তু বর্তমানে দেশের স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাদের মধ্যে ১৯৪ জনই স্কুলপড়ুয়া। আর কলেজপড়ুয়া ৭৬ জন এবং ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৪৪ জন মাদ্রাসাপড়ুয়া। এর আগে ২০২১ সালে দেশে মোট ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

বেসরকারি সংগঠন আচল-এর জরিপে দেখা গেছে, গত আট মাসে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন এই পথ বেছে নেয়, যাদের মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ ছেলে এবং ৫৩.৯৫ শতাংশ মেয়ে। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ স্কুলগামী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬৭.০১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদ্রাসাপড়ুয়া ৪৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে।

পত্রিকা থেকে সংগৃহীত আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ৩৬৪ জন আত্মহননের পথ বেছে নেয়, যারা তাদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছিলেন। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, নার্সিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছেন। লক্ষণীয়, ৩৬৪ আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১৯৪ জনই ছিলেন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থীরা, যার সংখ্যা ৭৬। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারীর সংখ্যা ৫০। তবে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীও ছিলেন ৪৪ জন।

শিক্ষাস্তর বিবেচনায় আত্মহননকারীদের মধ্যে বিদ্যালয়গামী অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী রয়েছে ৫৩.৩০ শতাংশ। আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা, যা ২০.৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৩.৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী রয়েছেন ১২.০৯ শতাংশ। আত্মহত্যায় এবারো এগিয়ে আছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা, যা মোট আত্মহননকারীর ৬০.৭১ শতাংশ বা ২২১ জন। অন্যদিকে ছেলে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৯.২৯ শতাংশ বা ১৪৩ জন। ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক, যা ৭৮.৬ শতাংশ। বয়সের সীমারেখায় যারা ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সি, তাদের মধ্যে ১৩.৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। জরিপ থেকে আরো জানা যায়, ১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারাও এই পথ থেকে পিছপা হয়নি। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭.৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ জন আত্মহত্যা করে। তবে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে ১৪-১৬ বছর বয়সিরা, যার সংখ্যা ১৬০। এছাড়াও সর্বনিম্ন সাত বছরের একটি শিশুও আত্মহত্যা করেছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

গবেষকদের মতে, আত্মহননের পেছনে যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেগুলো হলো- অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়া ইত্যাদি। আরো রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যার মতো বিষয়ও।

প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন। অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭.৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬.৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ৪.৬৭ শতাংশ। মানসিক সমস্যার কারণে এই পথে ধাবিত হন ৬.৫৯ শতাংশ। তাছাড়া পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০.৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ আত্মহননের দিকে যান। ১.৬৫ শতাংশ চুরির মিথ্যা অপবাদে, ১.৯২ শতাংশ আর্থিক সমস্যায়, ০.৫৫ শতাংশ বন্ধুর মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১.১০ শতাংশ। তবে ১৫.৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।

তবে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতার কারণগুলো বিভিন্নভাবে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষণ্নতা এবং মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন যে সামাজিক কারণগুলো হতাশা এবং মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। সুতরাং সামাজিক কারণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী।

আত্মহননকারী কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের মানসিক অবসাদ কিংবা বিদায় নেওয়ার কথা জানান দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন আটজন এবং ভিডিও কলে এসে আত্মহত্যা

করেন দুজন। আর সেলফি ক্যামেরা নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা করেন ০.২৭ শতাংশ প্রেমিক যুগল। এছাড়া মৃত্যুর আগে চিরকুট বা সুইসাইড নোট লিখে আটজন আত্মহত্যা করেছেন।

আবার অনেকে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তারা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন দেশের বিজ্ঞমহল। এ সম্পর্কে বিজ্ঞমহল মনে করেন, শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটরসাইকেল, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আত্মহত্যা বন্ধ করতে হলে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সমাজে বা দেশে এমন বয়সের কিছু ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে যাদের আত্মহত্যা বোঝার মতো বয়সও হয়নি, তার আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোও বিশ্লেষণ করে শিশু অবস্থা থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার ফলে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশোনার চাপও। এছাড়াও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও বেড়েছে আগের চেয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বেড়েছে, যেখানে আমরা আশা করেছিলাম করোনার পর আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যাবে।

আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে কমবয়সি স্কুলগামী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্কুলগামী আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই হার এত উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কোন কারণগুলো আছে, তা খুঁজে বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন এখন সময়ের দাবি। আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। এ জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close