তানজিব রহমান
দৃষ্টিপাত
লু হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে রাজনীতির সমীকরণ
‘মনোমুগ্ধকর নদী বা সৈকত এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি এখানে এসেছি আমাদের দুদেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বর্তমান বিশ্বশান্তি এবং নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে’... ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথাগুলো উচ্চারণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি তার বাংলাদেশ সফরের বিবরণ তুলে ধরতে প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতে কূটনীতিমুখর রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মুগ্ধতায় ভরা প্রশংসাসূচক এ কথামালা সবার নজর কাড়তে সময় নেয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করা মার্কিন এ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন মাত্রার কথা তুলে ধরা ছাড়াও কথা বলেছেন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। তিনি জানান, বাংলাদেশে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয় বরং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিকাশে সচেষ্ট ওয়াশিংটন। র্যাবের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে যা বেশ অসাধারণ অগ্রগতি, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে আমলে নিয়েছে। তিনি র্যাবের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন এভাবে- ‘এটি আসলেই অসাধারণ কাজ যার মাধ্যমে এটিই প্রমাণ হয় যে, র্যাব মানবাধিকারকে সম্মান করে জঙ্গিবাদ দমন এবং আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে কাজ করতে পারে, যা র্যাবের জন্য দারুণ একটি ইতিবাচক মূল্যায়নও বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য সুবিধার ব্যাপারে লু বলেন, যখনই জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) দেওয়ার অনুমোদন আসবে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় সর্বপ্রথম এ সুবিধা পাবে। ঢাকার তরফে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকার খুবই আন্তরিক। তবে নির্বাচন হবে সংবিধানের আওতার মধ্যে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলে পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে। তবে সংবিধানের বাইরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকার রাজনীতি এমনিতেই বেশ উত্তপ্ত, সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র আগমনে ঢাকার রাজনীতির সমীকরণও নতুন মাত্রা লাভ করেছে, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন, মানবাধিকার ও র্যাব ইস্যুতে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির সরকারকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানা ফাঁদ মঞ্চস্থ করে যাচ্ছিল কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ আগমন এবং বাংলাদেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনায় বদলে যেতে থাকে রাজনীতির নানান হিসাব কিতাব।
বিশেষ করে বিএনপির চলমান যুগপৎ আন্দোলনে নতুন কিছু বিষয় একটু ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। বিএনপি ও সমমনাদের যুগপৎ আন্দোলন শুরুর পর থেকে গণমিছিল, গণ-অবস্থান ও সর্বশেষ বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হয়। এ তিন কর্মসূচিতেই মঞ্চের সিনিয়র দুই নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব অংশ নেননি বলে খবর পাওয়া যায়। এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন চলছে। সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন চরমে পৌঁছেছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। যে কারণে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে যোগ দেয়নি জোটের অন্যতম শরিক গণঅধিকার পরিষদ। দলটির দাবি, নতুন হিসাবে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্য নেতারা গণঅধিকার পরিষদকে তেমন মূল্যায়ন করছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি। তবে গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, গণতন্ত্র মঞ্চের একটি সূত্রের দাবি, নূরের দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করার পর থেকে তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, এ পরিবর্তনের মূল কারণ কী এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তারা নিবন্ধন পাওয়ার আশায় তাদের দল পরিচালনায় কোনো ‘কৌশল’ নিয়েছেন কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এদিকে জাতীয় সংসদে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করেছেন গণফোরাম থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘তারা কী সেই মেরামত করতে চান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে? তারা কি সেই মেরামত করতে চান খুনি জিয়া যেমনিভাবে পাকিস্তানের দালাল জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সেরকম পরিবর্তন ব্যবস্থা করতে চান? জিয়ার দুঃশাসনে যে কারফিউর গণতন্ত্র, তারা কি সেই স্বৈরতন্ত্র করতে চান? তাদের কথা শুনলে মনে হয় ওই দিকেই যাচ্ছেন।’
২০১৪ এবং ২০১৮’র নির্বাচনে বিএনপি প্রতিহত কিংবা বর্জনের নামে সরে দাঁড়ালেও দেশের অন্যতম বৃহৎ এ রাজনৈতিক দল নির্বাচন-পরবর্তী গণসমর্থন থেকে ছিটকে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সাথে বিএনপির গোপন আসন ভাগাভাগি ও রাজনৈতিক সখ্য। যার কারণে ড. কামাল হোসেনসহ অনেক নেতা তখন বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যান। নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও বিএনপি গণসমর্থন আদায়ে জামায়াতঘেঁষা নীতি কিংবা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে মাঠের রাজনীতিতে তেমন সাহস দেখাতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে আরো প্রকট হয়ে ওঠে দলটির নেতৃত্বের সংকট। বাস্তবতা হচ্ছে, জামায়াত বিএনপির জন্য আশীর্বাদ না অস্বস্তি তা রাজনীতিতে প্রায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং উঠছে। এখন যে ৫৪ জোটের রাজনীতি চলছে, এখানেও কে কার আশীর্বাদ, কে কার জন্য স্বস্তি বা অস্বস্তি, তা যুগপৎ আন্দোলনগুলোর সর্বশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে আরো পরিষ্কার হয়ে উঠল। বিশেষ করে ডোনাল্ড লু’র আগমন এবং মূল নেতাদের প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণ না করার পেছনে রানৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে নানা রকম কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মির্জা সাহেবদ্বয়ের হাসপাতালে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তারা আসলে ডোনাল্ড লু ইস্যুতে আওয়ামী রাজনীতির কাছে পরাস্থ হয়েই জনগণকে আর ফেস করতে চাননি। কেননা দুদিন আগেও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার বক্তব্যে মার্কিন স্যাংশনের একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যা বিএনপির আশায় গুড়েবালি হয়ে যায়। বরং লু বাংলাদেশের সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমনে র্যাব এখন মানবাধিকার ইস্যু মাথায় রেখে কাজ করছে বলে র্যাবের প্রশংসা করেছেন। এবং তিনি এ বার্তাও স্পষ্টভাবে দিয়ে গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ দলের পক্ষে নয়। এর পরই স্যাংশন ইস্যুতে বিরোধীদের স্বর ও সুর নরম হয়ে গেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, অবাধ নির্বাচন, সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিদেশিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী ও যথাযথ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কারণ বিদেশিরা আমাদের বন্ধু মাত্র। এদেশের মাটিতে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করার দায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দলের ওপরই বর্তায়।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
"