আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

পরিবেশ

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বায়ুদূষণ রোধ জরুরি

মানুষ প্রতি ৪ সেকেন্ডে একবার শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করে। হিসাব করে দেখা যায়, মানুষের ৭০ বছরের জীবনে ৭৫ মিলিয়ন গ্যালন অক্সিজেনযুক্ত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। শুষ্ক ও পরিষ্কার বায়ুর প্রধান উপাদান হলো- নাইট্রোজেন ৭৮ ভাগ, অক্সিজেন ২০ দশমিক ৯৪ ভাগ ও আর্গন শূন্য দশমিক ৯৩ ভাগ। যে কোনো জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য বিশুদ্ধ বায়ু ও বায়ুর উপাদানের স্বাভাবিক মাত্রা অত্যাবশ্যক। এই বায়ুর মধ্যেই মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে আছে। বায়ু আছে বলেই পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি, প্রাণী ও উদ্ভিদের বিপুল ও বিচিত্র সমারোহ। আমাদের চারপাশের সব জড় ও জীবকে নিয়ে গড়ে উঠেছে পরিবেশ। এই জীব ও জড়ের মধ্যে রয়েছে নিত্যদিনের সম্পর্ক এবং এ সম্পর্কের কারণে আমাদের চারপাশে ঘটছে নিত্যদিনের বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড। অনেক সময় এ কর্মকাণ্ড যখন স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারে না, তখন দেখা দেয় সংকট। আসলে এই সংকটের বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বায়ুর কোনো কোনো উপাদানের পরিমাণ বেড়ে বা কমে যাচ্ছে। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

পরিবেশ ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অব্যাহত থাকে জীবনচক্র। মানুষ তার বিরাট চাহিদার জন্য ইচ্ছামতো পরিবেশকে ব্যবহার করছে। ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে অসংখ্য মোটরযান যখন ধোঁয়া নির্গত করে, তখন মনে হয় যেন দম আটকে গেল। শুষ্ক মৌসুমে ব্যক্তিগত যানবাহনের ধোঁয়া ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এমন ধারা কিছুদিন চলার পরেই শুরু হয় শ্বাসকষ্টজনিত নানা জটিল রোগ। তাছাড়া ঢাকার তাপমাত্রা অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় দিনে দিনে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এশিয়া মহাদেশেও পরিবেশগত ইস্যুগুলো অধিকতর প্রাধান্য পাচ্ছে। বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে দিল্লি। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। বন্যপ্রাণীর চেয়েও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এখন ৮০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে বায়ুদূষণ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ২০১৫ সালে প্রায় ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ এই বায়ুদূষণ। আর এসব অকাল মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি ঘটেছে চীন ও ভারতে। এসব দেশে প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন নির্মল বায়ুর এলাকায় বসবাসের সুযোগ পান। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ২০১২ সালে বায়ুদূষণের কারণে পৃথিবীতে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে- পিএম ২ দশমিক ৫। বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যুর সরাসরি কারণ এই বায়ুদূষণ। এতদিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে জাপানের টোকিও। প্রতিবেদনটিতে মূলত কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়েছে।

অপরদিকে ২০১৫ সালে গবেষণা সংস্থা নাসা এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে ঢাকার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। এ সময় ৭৯ শতাংশ বিষাক্ত এই গ্যাস বাতাসে প্রবহমান ছিল। রাজধানী ঘিরে থাকা কয়েক হাজার ইটভাটার এবং যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া ঢাকাকে দূষণের অন্তিম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ঢাকার বাতাসে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ উপাদান পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রাও রয়েছে, যা ভারত ও চীনের পরের অবস্থানে। পিএম ২ দশমিক ৫ ছাড়াও বায়ুর অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে সামগ্রিক দূষণের একটি চিত্র ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, পিএম ২ দশমিক ৫-এর নিরাপদ কিংবা সহনীয় মাত্রা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির কারণে সৃষ্ট দূষণ আর দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের সংস্পর্শে থাকার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ ও নতুন রোগে ২০১৯ সালে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাতাসে কার্বন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মিশ্রণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এই অপমৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

পৃথিবীর চারপাশের বায়ুমণ্ডল বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে। দূষিত বায়ু সুস্থ পরিবেশের জন্য বাধা। বায়ুদূষণের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যাওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি অব্যাহত থাকে তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে পৃথিবীর সমুদ্র উপকূলবর্তী নিচু স্থলভূমি পানিতে ডুবে যাবে। আবার কোনো কোনো অঞ্চল খরার কবলে পড়বে। ফলে স্থানীয় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটবে। এতে শুধু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য ১২৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি আইন বলবৎ করা হয়। ১৩০০ সালে সম্রাট এডওয়ার্ড-১, এক রাজ-ঘোষণায় বলেন, কয়লা দহনে বায়ুদূষণ সংঘটনকারী ব্যক্তির শির- েদ করা হবে। কানাডার সুপ্রিম কোর্ট এক মামলার রায়ে বলেন, বায়ুদূষণ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ হারে পরিবেশ দূষণ কর এবং যে এলাকায় পরিবেশ দূষণ করছে, সেই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য জনস্বাস্থ্য কর দিতে হবে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘সুভাষ কুমার বনাম বিহার রাজ্য’ (১৯৯১) মামলায় বলেন, প্রতিটি নাগরিকের বিশুদ্ধ নির্মল বায়ু পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ‘জীবনধারণের অধিকার’ সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার হিসেবে দূষণমুক্ত বায়ু পাওয়ার অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে এবং সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জীবনধারণের জন্য গুণগত মান’ ব্যাখ্যা করে বলেন, জীবন ধারণের গুণগত মানের জন্য দূষণমুক্ত বায়ু পাওয়াকে জীবন ধারণের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদণ্ড১৮-তে বর্ণিত আছে, ‘জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং অনুচ্ছেদণ্ড১৮কঃ তে বর্ণিত আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ তাই বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের চিন্তা করা উচিত নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ ছাড়া প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য কোনোটিই নিরাপদ নয়। সরকারের স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য, দিল্লি সরকার যেভাবে পরিবেশ দূষণ রোধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশ সরকারও এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

বায়ুদূষণ রোধ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উপায় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম উপায়। ঢাকার দূষণ কমাতে প্রথমেই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে থাকা ইটভাটা বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। খাদ্য তৈরিতে সবুজ গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড উপাদানটি সংগ্রহ করে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। গাছের পাতা বায়ু পরিশোধনের ছাঁকনি

হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আমরা এই গাছপালা নির্বিচারে কেটে ফেলছি।

ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুদূষণ রোধে শহর ও তার আশপাশে প্রচুর গাছ লাগানোর জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবুজে সাজাতে হবে আপন বাসগৃহ। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে আবাসন প্রকল্পকে সবুজে ঘিরে রাখতে হবে। আমরা চাই ঢাকা হোক সবুজ সমারোহে নির্মল বায়ুযুক্ত একটি আধুনিক নগরী। শহরের বাসাবাড়ির বারান্দা ও ছাদে বাগান করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close