আবু আফজাল সালেহ

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

মুক্তমত

ঢাকা মহানগর : সুষ্ঠু নগরায়ণ পরিকল্পনা

ঢাকা শহরে স্বচ্ছন্দে চলাচলের কোনো উপায় নেই। আমরা যদি গাড়িতে চড়ি, তাহলে ঘণ্টায় মাত্র পাঁচণ্ডছয় কিলোমিটার চলতেই হিমশিম খাই। এটা তো আদর্শ শহরের লক্ষণ হতে পারে না। আদর্শ তো দূরের কথা, একটা ভালো শহরের নমুনাও হতে পারে না! বেশিরভাগ ফুটপাত বেদখল হয়ে যায়। পথচারীরা ব্যবহার করতে পারে না। বিভিন্ন দোকানে ভরে গেছে। বিভিন্ন কারণে কর্তৃপক্ষ কিছু করে না বা করতে পারে না! যানবাহন, ইটভাটা প্রভৃতির কারণে ঢাকা বায়ুদূষণে অন্যতম শীর্ষে। এসব বিবেচনায় ঢাকা একটা বিপজ্জনক মহানগর বলা যেতে পারে।

১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে যে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়, সেটা ছিল একটা প্রদেশের রাজধানীর জন্য। সর্বোচ্চ ২০ লাখ লোকের কথা বিবেচনা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা দেশের রাজধানী হয়ে গেল। নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হলো। খুব দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বাড়তে লাগল, যানবাহনও বেড়ে গেল। বিগত কয়েক বছরে তো দ্রুত বেড়ে গেল। প্রয়োজনের কারণে ঢাকার আশপাশে ইটভাটাও বেড়ে গেল। কলকারখানাও বেড়ে গেল দ্রুতগতিতে। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্যও দ্রুত নষ্ট হতে লাগল। এখন নেতিবাচক দিকগুলো হুমকি দিচ্ছে। আগে নগর-পরিকল্পনায় পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। আর এখন বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠু নগরপরিকল্পনা নেওয়া যাচ্ছে না বা করতে পারছি না! এমন চললে ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এখনই প্রায় অনুপযোগী হয় পড়বে। বাংলাদেশে মানসম্মত গৃহের বিরাট ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬৫ মিলিয়নের মতো এবং ক্রমবৃদ্ধিশীল। বছরে অন্তত ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ নতুন মানুষ মোট জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ধ্বংসও হচ্ছে। ফলে আবাসন সংকট প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১৬ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-পরবর্তী সময়ে দেশে প্রতিবছর অন্তত ১ মিলিয়ন নতুন গৃহনির্মাণ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের অগ্রগতি আরো ভালো হতে হবে। মানস¤পন্ন গৃহ বা আবাসনের প্রতিবেশ বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকেও বিবেচনায় আনতে হুয়। আবাসন প্রক্রিয়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্যচর্চার সুযোগও থাকবে। ঢাকা এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো মহানগরে একেবারে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশাল। মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি হবে। এদের একাংশ বস্তি এলাকায় আশ্রয় নেন। ঝুপড়ি, কাঁচাঘর, টিনশেড, আধাপাকা, এমনকি পাকা ঘর। ঢাকার মতো মেট্রোপলিটন মহানগরে অবিশ্বাস্য হারে বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা নগরীতে ২ দশমিক ৭৫ লাখ বস্তিবাসী ছিল, ২০০৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ লাখে উপনীত হয়। ২০০৫ সালের ৩৪ লাখ বস্তিবাসীর সঙ্গে বিগত ১৪ বছরে অন্তত আরো ১৬ লাখ যুক্ত হয়েছে। তাই বলা যায়, ঢাকা মহানগরীতে ৫০ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। এদের সঠিক সংখ্যা জানাটাও কঠিন কাজ।

বাংলাদেশের সংবিধানে সবার জন্য বাসযোগ্য আশ্রয় দর্শন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ২০১৬-তে দেশের সব শ্রেণি, গোত্র, গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় আবাসনের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার কথাও বলা হয়েছে। গৃহায়ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশী কর্তৃপক্ষ, সংস্থা, গোষ্ঠী, প্রাইভেট সেক্টর, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। আবাসন-সংকট সমাধানে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ভূমির সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শহর ও গ্রামাঞ্চলের অব্যবহৃত খাস, পতিত ও জেগে ওঠা চরের জমি নিয়ে ভূমি ব্যাংক তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায়। দেশের মানুষের আবাসন চাহিদা মোকাবিলায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। তবে বর্তমানে প্লট-ফ্ল্যাট কেনাবেচায় অতিরিক্ত কর, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে আবাসন খাতের মন্দা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফলে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও সঠিক ফল পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। আবাসন তথা গৃহায়ন নীতিমালা যেন এক্ষেত্রে সহায়ক হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। আশার কথা, জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নীতিমালাটির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই কেবল এ উৎসাহ কাজে আসবে। আর একটা দিক ভাবার মতো। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নগর জনগোষ্ঠী ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ এবং বর্তমানে সেই সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালে নগর ও গ্রামীণ জনসংখ্যা সমান হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের ব্যাপক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তবে বর্তমান সরকারের প্রথম নির্বাচনি অঙ্গীকার হচ্ছে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকার অনেক প্রকল্প ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসব সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হলে শহরমুখী জনস্রোত কমে যাবে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নগরায়ণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় নগর নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা নগর জনগণকে সব পরিষেবা প্রদানে সক্ষম হবে।

রাজধানীর আশপাশের শহরগুলোকে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলতে হবে। এজন্য অফিস-আদালত স্থানান্তর করা যেতে পারে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ বা মুন্সীগঞ্জে কিছু অফিস স্থানান্তর করতে হবে। এটা করলে উন্নত বাজার হবে এসব স্থানে। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিভাগ, জেলা, উপজেলার প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়াতেই হবে। এতে ঢাকামুখী জনস্রোত কমবে। রাজধানীর চাপ কমবে। এর বিকল্প খুব কম আছে বলে মনে করি। এটা করলে রাজধানীর অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি। আমরা জানি, উৎপাদনশীলতার বিবেচনায় নগর হলো অপার সম্ভাবনার উৎস। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)’ অর্জন করার জন্যই টেকসই নগরায়ণ প্রয়োজন। আর এজন্য সরকারি-বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগের একটা সমন্বয় থাকতে হবে। সুষ্ঠু-নগরায়ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সরকারের সঙ্গে সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। যার-যার ক্ষেত্র তার তার কাজ যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা বিরাট এ কর্মযজ্ঞ শুধু সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close