আহমেদ আমিনুল ইসলাম

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

বিশ্লেষণ

কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে ঐক্যবদ্ধ হোন

আওয়ামী লীগ তার নিজ দল নিয়ে চিন্তাভাবনা করুক। নির্বাচনকে সামনে রেখে তা-ই করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। বিএনপির মিটিং-মিছিল বা সমাবেশ থেকে ঘোড়ার ডিম হলো না হাতির ডিম হলো তা নিয়ে টিপ্পনী কিংবা জনসভায় মানুষের উপস্থিতি নিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। এসবের মাধ্যমে বিএনপিকে কৌশলী ও সচেতন করে দেওয়ার দাওয়াই সরকারি দল আওয়ামী লীগকে কেন দিতে হবে, তা ভেবে পাই না। দেশে-বিদেশে বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীর সংখ্যা যথেষ্ট। তাই আমাদের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের উচিত বিএনপিকে দাওয়াই না দিয়ে তাদের কর্মসূচি নিয়ে ব্যঙ্গোক্তি বা টিপ্পনী না করা। ‘মরা শামুকেও পা কাটে’ গ্রামীণ এ প্রবাদটির কথা আওয়ামী লীগ মনে রাখলেই বরং ভালো করবে।

আমরা লক্ষ্য করছি সরকারি দলের বিভিন্ন সারির বেশ কিছু নেতাকর্মী ও মন্ত্রী বিএনপির আন্দোলন, সভা, সমাবেশ ও মিটিং-মিছিল নিয়ে সময়ে সময়ে নানা রকমের কটূক্তি এবং নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ টিকাণ্ডটিপ্পনী কাটছেন! এসব টিকাণ্ডটিপ্পনীর অর্থ হচ্ছে বিএনপিকে তারা কোনো প্রকার ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না! বিএনপি কি আদৌ সেরকম জনসমর্থনহীন কোনো সংগঠন, যে দলটি সম্পর্কে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনর্থক এবং অহেতুক কেবল ব্যঙ্গাত্মক টিপ্পনী কাটার মাধ্যমে তাদের উসকে দিতে হবে? এখনো দলটির ব্যাপক জনসমর্থন আছে। বাস্তবতা হলো বিএনপিকে যথার্থ দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব দিয়ে এই জনসমর্থন কাজে লাগানোর যোগ্য একজন নেতার অভাব! কিন্তু আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, আবেগের কাছে এবং বিশেষ বিশেষ হুজুগের কাছে সব রকমের বাস্তবতাই পরাভূত হয়! আমরা জানি, আওয়ামী লীগের জনসমর্থনও ব্যাপক এবং সাংগঠনিকভাবেও অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু তাই বলে সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের আর দরকার নেই এ কথা কি বলা যায়? আবার এও মনে রাখা জরুরি, বড় দলের মানেই হলো বড় বড় নেতার সংখ্যাধিক্য! বড় বড় সব নেতার যথার্থ মূল্যায়ন কোনো বড় দলের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। আর এজন্যই দলের ভেতর সৃষ্টি হয় নানা রকমের উপদল! সম্প্রতি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা এরও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি। জাতীয় পার্টির নির্বাচিত মেয়রও ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, রংপুরে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ ছিল না। এই যদি হয় বিরোধী প্রার্থীর উপলব্ধি, তাহলে নির্বাচনকালীন দলীয় প্রার্থী সেখানে কতটা অসহায় ছিলেন, তা আমাদের উপলব্ধির বাইরে! অর্থাৎ ‘নেতৃত্বের মূল্যায়ন’ না হলেই বহুল কথিত ‘ঘরের মধ্যে ঘর, দলের মধ্যে দল’ সৃষ্টি হতে বিন্দু পরিমাণ সময়ও লাগে না! সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনৈক্যের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন! কাজেই আমরা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করব ‘ঘরের মধ্যে ঘর, দলের মধ্যে দল’ যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে বেশি মনোযোগ দিতে। বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটের আন্দোলন-সংগ্রাম ও সভা-সমাবেশ নিয়ে অহেতুক ব্যঙ্গোক্তি বা টিপ্পনী কাটার বদলে এ মুহূর্তে দলকে সুসংগঠিত করায় মনোযোগ দেওয়াই বেশি কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত।

চলমান বছরটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছর শেষ হওয়া মাত্রই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরেই আমরা দেশে-বিদেশে নানা ধরনের বিস্তৃত ষড়যন্ত্র-জাল দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই মনে রাখছে, পরপর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে জনপ্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর দ্রব্যমূল্যের এমন উচ্চহারকে সাধারণ মানুষ নেতিবাচকভাবেই বিবেচনা করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ যে অনেক ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক, সরকার বা দল জনগণকে তা সম্যকভাবে বোঝাতে পারেনি। পাশাপাশি তিন মেয়াদে টানা ক্ষমতায় থাকায় দেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সে সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ এখনো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয়। এরূপ ক্ষেত্রে বরং বিরোধীদের প্রপাগান্ডা মতো ‘মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি’র মিথই সাধারণের মনে বদ্ধমূল হয়েছে। আওয়ামী লীগকে সাধারণের মন থেকে মিথ্যা ‘মিথ’ দূরীভূত করতে হবে। সাধারণ মানুষ দেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন চাইলেও একশ্রেণির রাজনীতিবিদ সুস্থধারার রাজনীতির পরিবর্তে সাধারণের মনকে নানা অপকৌশলে উন্নয়নের প্রতি অনীহ করে তুলছে। গণতন্ত্রের নামে, তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে, সরকার উৎখাতের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে একাধিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অনেকেই। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনমুখী না হয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং ক্ষমতা দখলের জন্য একটি গোষ্ঠী যারপরনাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছে! যে কোনো প্রকারেই হোক অতি দ্রুত তাদের ক্ষমতায় যেতেই হবে, ক্ষমতা ছাড়া কোনো অভীষ্টই এদের সম্মুখে অবশিষ্ট নেই!

পরিবর্তন চাওয়া মানুষের সহজাত প্রবণতার একটি। কিন্তু মানুষ কোন ধরনের পরিবর্তন চায়- যে পরিবর্তনের ফলে আবারও দেশজুড়ে জেঁকে বসবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি, সেই পরিবর্তন? না, এদেশের মানুষ সে ধরনের কোনো পরিবর্তন চায় না। দেশবাসী ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসন প্রত্যক্ষসহ গণতন্ত্রের যুগ বলে খ্যাত ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদের রাষ্ট্র পরিচালনাও দেখেছে। এ সময়পর্বে এদেশের মানুষ দেখেছে শাসকের তাৎক্ষণিক ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কীভাবে পাল্টে যায়- কীভাবে দেশ পশ্চাদগামী যাত্রায় উন্মুখ হয়, বারবার দুর্নীতিতেই হয় চ্যাম্পিয়ন! এ সময়পর্বেই মানুষ দ্বৈত-শাসনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়- একদিকে বিএনপি-জামায়াতের রাষ্ট্রীয় অপশাসন ও বঞ্চনা; অন্যদিকে হাওয়া ভবনের নীরব দুঃশাসন ও বঞ্চনা।

আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে এদেশের মানুষ পুনরায় লুটেরা জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে, সে বিশ্বাস আমাদের মনে স্থান নিতে পারে না। যদি আওয়ামী লীগের চেয়ে আরো উন্নয়নকামী, আরো প্রগতিশীল কোনো শক্তির আবির্ভাব হয়, তা ভিন্ন কথা। কিন্তু সহসা সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ! বিএনপি-জামায়াতের উচ্ছিষ্টভোগী বামণ্ডডান ও মধ্যপন্থার ভ্রষ্টচারীরা রাজনৈতিক আবরণ গায়ে চাপিয়ে একত্রে মিলিত হয়েছে, নানা রঙের চাদরে আবৃত হয়ে জোট গঠন করছে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে! এদের মধ্যে কিছু তরুণও যুক্ত হয়েছেন, যারা তাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই নানা রকমের মিথ্যাচারের অভিযোগে জর্জরিত, বিতর্কিত ও নিন্দিত! অসংলগ্ন মানসিকতায় এদের আপাদমস্তক জর্জরিত! এদের মুখের ভাষা ও দেহভঙ্গির ইঙ্গিতে ভবিষ্যৎ যে বাংলাদেশের চিত্রকল্প জাগিয়ে তোলে তা ভাবা যায় না! আবেগি ও উৎসাহী কিছুসংখ্যক সমর্থকের হুজুগে তারা যে শর্টকাট পন্থায় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের স্বপ্ন দেখে, তা দেখেও স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়! রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই ক্ষমতালাভ ও ক্ষমতার লোভের জন্য এমন হন্তদন্ত-ভাব এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কেউ কখনো দেখেনি!

মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ সমুন্নত রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিয়ে তরুণরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিপরীতে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগটি নিতেই পারতেন। সেটিই বরং রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করত। শর্টকাট পন্থায় ক্ষমতার মসনদ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা রাজনীতিকেই কলুষিত করে। কিছু তরুণ রাজনীতির নামে অতিকথনের যে বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন, তা ‘লোভ’ ছাড়া কিছু নয়! এরা সফল (!) হলে তা জাতির জন্য বিষবৃক্ষ ছাড়া কিছুই হবে না।

এদিকে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনেরও ঘোষণা দিয়েছেন! অবশ্য এটি তাদের নতুন কোনো ইস্যু নয়- ২০০১-২০০৬ শাসনামলেও তারা নানা রকমের পরিবর্তনের কথা বলে উসকানি দিয়ে জাতীয় আবেগকে ক্ষতবিক্ষত করেছে! সে সময় তো জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপককে দিয়ে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল! এ কথা ঠিক, এবার বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে আর কোনো প্রস্তাব বা জাতির মনোভাব বোঝার নিরীক্ষায় প্রবৃত্ত হবে না- যাকে বলে একেবারে ‘খোলনলচে’ পাল্টে ফেলারই উদ্যোগ নেবে! সংবিধানসহ কোনো পরিবর্তনেই জাতি মানসিক প্রস্তুতিরও সময় পাবে না! সংবিধান পরিবর্তনের পাশাপাশি তারা জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সংস্কার-সংস্কৃতির ওপরও যে ক্ষমতার দাপট দেখাবে, তা নিয়ে সংশয়েরও অবকাশ নেই। তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে সত্যি সত্যি আমাদের ভুলিয়ে দেবে, ‘আমরা একদিন বাঙালি ছিলাম রে...’!

দলটির প্রতিশোধের রাজনীতির সঙ্গে সবাই পরিচিত। ২১ আগস্ট তাদের সেই পরিচয় খুব ভালোভাবেই আমরা পেয়েছি। তাই হুজুগের তথাকথিত পরিবর্তনের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই। তারা কখনোই আর পেছনের দিকে ফিরে যাবে না বলেও আমাদের বিশ্বাস। দেশের মানুষ বিগত ১৪ বছরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শিখেছে। দেশের মানুষ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের উন্নয়নের সুফল পেতে শুরু করেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কর্ণফুলী টানেলের সুফল পাবে। সুফল পাবে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের সুবিধাও।

সম্প্রতি কানাডাভিত্তিক একটি আর্থিক জরিপে বৈশ্বিক টালমাটাল অর্থনীতির মধ্যেও বাংলাদেশ সুদৃঢ় অবস্থান ধরে রেখে বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান অধিকার করেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ২০৩৫ সালে বিশ্বের ২০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। বিগত ১৪ বছরে জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়েছে। উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি স্মার্ট রাষ্ট্র গঠনের গন্তব্যে পৌঁছার এসব নিয়ামক অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে আওয়ামী লীগকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close