মনিরুল হক রনি
শ্রদ্ধাঞ্জলি
বেগম রোকেয়া নারী মুক্তির অগ্রনায়ক
সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অগ্রনায়ক মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তা ছিল অতি রক্ষণশীল। শুধু তার পরিবারই নয়, তৎকালীন পুরো সমাজটাই ছিল ধর্মীয় কঠোর বিধিনিষেধ দ্বারা শাসিত। সেই গোঁড়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আধুনিক চিন্তাচেতনা ও মন মানসিকতাসম্পন্ন একজন প্রতিবাদী নারী। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার বাইরে এসে নারীদের শিক্ষা অর্জন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তিনি বড় ভাইবোনদের উৎসাহে এবং পরবর্তী সময়ে স্বামীর সাহচর্যে শত বাধা সত্ত্বেও সেই রক্ষণশীল সমাজের বাইরে এসে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং নারীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন। মুসলিম নারী সমাজের মধ্যে অশিক্ষা, কুসংস্কার, পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ি তাকে ভীষণভাবে পীড়িত করে তুলেছিল। তাই তিনি প্রথাগত সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করে নারীর মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তার নারী মুক্তি আন্দোলন কোনো পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে ছিল না বরং তা ছিল মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি নীচু মানসিকতার বিরুদ্ধে। তার নারী মুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল পশ্চাৎপদ মুসলিম নারীসমাজকে পুরুষশাসিত সমাজের কবল থেকে মুক্ত করা।
বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার কল্পনার নারীকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা অতো সহজ নয়। এজন্য শুধু সমাজে পরিবর্তন আনলেই চলবে না, পরিবর্তন আনতে হবে নারীর মনোজগতেও। আর সেজন্য নারীর শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বুঝেছিলেন, নারীর পশ্চাৎপদতা, অধস্তনতা ও পরাধীনতার মূল কারণ তাদের শিক্ষার অভাব। ‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি...। আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি’- এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজকে উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন নারী শিক্ষার গুরুত্বকে। কেবল মানসিক বিকাশ নয় বরং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যথার্থ ভূমিকা পালনের জন্যও যে শিক্ষার প্রয়োজন, সে কথাও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তৎকালীন সমাজে পরিবারের অর্গলমুক্ত হয়ে নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। সেসময় শিক্ষাকে শুধু পুরুষের একার অধিকার মনে করা হতো। তিনি সেই সমাজের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে ১৯০৯ সালে মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্বামীর নামে ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। যেখানে মেয়েদের শিক্ষারই কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি। দমে যাননি। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসেছেন। তাদের শিক্ষিত করে তুলেছেন। শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, নারী মুক্তির বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে নারী শিক্ষার পক্ষে জোর প্রচারণাও চালান তিনি। যদিও তৎকালীন সমাজ তার এই উদ্যোগকে ভালোভাবে নেয়নি। বরং নিন্দা ও ঘৃণার চোখে দেখেছেন অনেকে। তবুও কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরে বেগম রোকেয়া বুঝলেন মুসলিম মহিলাদের দাবি আদায়ের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দরকার। আর তাই বাংলার মুসলিম নারীদের বিভিন্ন দাবি আদায় এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরির জন্য ১৯১৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি ছিল বেগম রোকেয়ার নারী আন্দোলন ও নারীমুক্তির একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ।
এর আগে রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও নারী আন্দোলন ও নারী মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন ঠিকই। তবে তাদের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার পার্থক্য এখানেই যে, পূর্বোক্ত আন্দোলনে নারীর প্রকৃত মানসিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয় ছিল প্রায় অনুপস্থিত। তারা নারীকে দেখেছিলেন সহানুভূতির দৃষ্টিতে। আর বেগম রোকেয়ার ভাবনা ছিল সেটার ঊর্ধ্বে। তিনি সহানুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে নারীর মানসিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। চারপাশের নারী সমাজকে তিনি দেখেছেন দরদী হৃদয় ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হয়, তবে পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে না কখনোই। তিনি চেয়েছিলেন, “সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক; পুরুষের পাশাপাশি তারাও স্বাবলম্বী হোক; শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞানে-কর্মে পুরুষের মতোই যোগ্যতা অর্জন করুক; সামাজিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের মতো নারীও সমান অবদান রাখতে সক্ষম হোক।” নারী জাতিকে তিনি আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য তিনি কলম ধরেছেন শক্ত হাতে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পে তিনি তার কল্পনার নারীকেই দেখিয়েছেন সমাজকে। নারীরা শুধু অন্তঃপুর ও রন্ধনশালার অন্ধকার পরাকাষ্ঠে আর কাব্য-কবিতার ছন্দে আবদ্ধ থাকবে সেটা তিনি মানতে পারতেন না। তাই তিনি বাস্তব জ্ঞানের আলোকে ‘অবরোধবাসিনী’ লিখে সমাজকে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে।
বেগম রোকেয়া যে পরিবারে এবং সমাজে বেড়ে ওঠেন সেখানে ভাষা হিসেবে উর্দু, ফারসি ও আরবির ছিল জয়জয়কার। এসব ভাষায় কথা বলা ও পড়াশোনা করা ছিল অনেকটা ধর্মীয় বিধি-বিধানের মতো। ইংরেজি ভাষাকে মনে করা হতো বিজাতীয় ভাষা। বাংলাকেও দেখা হতো অনিহার চোখে। যদিও তিনি চোস্ত ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন, তবুও তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি দেখলেন- বাংলার নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে বাংলার বিকল্প নেই। এজন্য তিনি তার সব রচনাই লিখলেন বাংলা ভাষায়। ‘সুলতানা’স ড্রিম’ নামে ইংরেজিতে প্রথমে একটি বই লিখলেও পরে সেটার বাংলা অনুবাদ করেন তিনি নিজেই। বাংলার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ ও ভালোবাসা। সে সময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাংলাতে লেখাও ছিল এক ধরনের বিপ্লবী কাজ। বাংলা ভাষার প্রতি তার অবস্থান ছিল যে কত দৃঢ়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে তার জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ।
তৎকালীন প্রতিকূল পরিবেশে বেগম রোকেয়া দৃঢ় মনোবল ও অসীম সাহসীকতাকে পুঁজি করে আমৃত্যু নারীর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। তার সব ধ্যানে-জ্ঞানে, চিন্তাচেতনায়, মনে ও মননে ছিল নারী। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। তিনি যে নারী জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর এ পর্যায়ে এসে আজ তা কতটুকু পূর্ণ হয়েছে, তা আলোচনার বিষয় হলেও এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর মুক্তির জন্যে যে আন্দোলনের সূচনা তিনি করেছিলেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। নারীর জাগরণ, নারীদের প্রতি সব বৈষম্যের অবসান, নারী জাতিকে তাদের স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত করা এবং নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তার অবদান স্বর্ণালী অক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় ইহলোক ত্যাগ করেন।
লেখক : শিক্ষক, সমাজকর্মী ও কলাম লেখক
"