মোতাহার হোসেন

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২২

পরিবেশ

বায়ুদূষণ রোধে চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। উন্নয়নের সুফল দেশময় ছড়িয়ে দিতে তাই রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়েও চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত ডজনখানেক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে সমান তালে। কিন্তু এসব মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য উন্নয়নকাজ করার ক্ষেত্রে পরিবেশ, প্রতিবেশ, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের বিষয়টি সম্পূর্ণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি- এমন অভিযোগ নগর-পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের। কিন্তু উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণে মানুষের শারীরিক ও বহুমুখী ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এমনটি প্রত্যাশা নগরবাসীর।

বর্তমানে রাজধানীতে মেট্রোরেল, রাজধানীর উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত র‌্যাপিড ট্রানজিট রুট নির্মাণ, ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, টিঅ্যান্ডটি, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন উন্নয়নকাজে বছরজুড়েই থাকে বাতাসে ধুলাবালির বিচরণ। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশে উন্মুক্ত ইটভাটাতে কাঠ, কয়লা পোড়ানোতে বাতাসকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে। একইভাবে শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়ায় বাতাসকে ক্রমাগত দূষিত ও বিষাক্ত করছে। এসব কারণে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময়ে দিনের বেলায় বায়ুদূষণে আক্রান্ত থাকে সর্বাধিক বেশি। রাজধানীর বায়ুদূষণ দেশে অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে অনেক বেশি। আবার যানবাহনের কালো ধোঁয়া, উচ্চস্বরে হর্ন বা হাইড্রোলিক বাজানো, বাড়িঘর নির্মাণের কারণে নির্মাণসামগ্রীর জঞ্জাল, ইট-সুরকির কণা বাতাসকে দূষিত করে। একই উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ সৃষ্টি করে। উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণে বছরে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। পাশাপাশি মানুষ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক ও আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশজ উৎপাদন-জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৯ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশেষ করে বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, হৃদরোগ, এজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং বিষণ্নœতার ঝুঁকি। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশু, বয়স্ক এবং সহজাত রোগে আক্রান্তরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। এদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্তরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাংক বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে উপরোক্ত তথ্য উঠে এসেছে। তথ্যটি সত্যিই নগরবাসীর জন্য উদ্বেগের, সরকারের জন্য চিন্তার।

বিশ্বব্যাংক এ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান ড্যান চেন। অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এবং স্বাস্থ্যসচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের হেলথ স্পেশালিস্ট ওয়ামেগ আজফার রাজাসহ অনেকে। ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঢাকা ও সিলেটের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বহিরাঙন বায়ুদূষণের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব কমাতে প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য পরিষেবা এবং প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়ার উন্নতির কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বায়ুদূষণের ডেটা মনিটরিং সিস্টেমের উন্নতি, প্রারম্ভিক ওয়েমিং সিস্টেমে বিনিয়োগ এবং গবেষণা বাড়ানোসহ অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে বড় নির্মাণ এবং ক্রমাগত যানবাহন চলাচলের এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় বায়ুদূষণ এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। বায়ুদূষণের দিক থেকে পরের অবস্থানে বৃহত্তর ঢাকার ইটভাটার পার্শ্ববর্তী এলাকা। বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া, নবীনগর, কালিয়াকৈর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহারে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৩৬ শতাংশ বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ইটভাটাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় নির্মাণ এবং যানজটের কাছাকাছি বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এ ছাড়া সিলেট বিভাগ, যেখানে দেশের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ু রয়েছে, সেখানেও ডব্লিউএইচও নির্দেশিত জিআইএমডব্লিউ পিএমণ্ড২ ঘনত্বের মাত্রা ৮০ শতাংশ বেশি। এটি প্রতিদিন ১২টি সিগারেট খাওয়ার সমান।

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে দূষিত বিভাগ ঢাকা এবং সবচেয়ে কম দূষিত সিলেট। বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চল (খুলনা ও রাজশাহী) পূর্বাঞ্চলের (সিলেট ও চট্টগ্রাম) চেয়ে বেশি দূষিত। ঢাকা বিভাগে স্থানীয় দূষণ ছাড়াও পিএমএস ঘনত্বের এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত আন্তসীমান্ত উৎস থেকে আসে। তথা রাজধানীর পাশর্^বর্তী অঞ্চলের ইটভাটা, শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়াকে এজন্য দায়ী করা হয়।

ডব্লিউএইচও নির্দেশিত মাত্রার তুলনায় পিএমএএসএ ১ শতাংশ বেশি হলে একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে। এর ফলে ভেজা কাশি হওয়ার সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তে পারে। এ ছাড়া নিম্ন শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে যায়। বায়ুদূষণ মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডব্লিউএইচও নির্দেশিত মাত্রার ওপরে পিএমণ্ড২-এর সংস্পর্শ ১ শতাংশ বাড়লেই হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

এ ক্ষেত্রে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে নিরাময়মূলক জনস্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি আবশ্যক এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রচার অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। বায়ুমানের ডেটার নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং আরো গবেষণা বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা দরকার।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান চেন বলেন, শিশু থেকে বয়স্ক সবাইকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে বায়ুদূষণ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ ছিল বায়ুদূষণ। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের তালিকায় আধিপত্য বজায় রেখেছে। এর আগে বৈশি^ক বায়ুমান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক দিন থেকে ঢাকা পৃথিবীর দূষিত নগরীর মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকছে।

এ অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

দেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজ চলতে থাকে। কাজে ব্যবহৃত মালপত্র ঢেকে রাখা হয় না। উন্নত বিশ্বে নির্মাণকাজ বিশেষভাবে ঢেকে এবং কম সময় নিয়ে করা হয়। এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় বছরব্যাপী এবং মাটিগুলো রাস্তার পাশেই রাখা হয়। এগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে গার্মেন্ট এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায় ব্যাপকভাবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ঢাকার আশপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেগুলো দূষণের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। পৃথিবীর অনেক দেশে ইটভাটা নেই। তারা সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করে। ব্লক ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

আবার কখনো কখনো গৃহের ভেতর দূষণ (ইনডোর এয়ার পলিউশন) হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত রান্নাঘর ব্যবহারে বিষয় চিন্তাভাবনা করা জরুরি। এজন্য সরকারি পর্যায় থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি দরকার। বায়ুদূষণের কারণগুলোই বলে দিচ্ছে এ দূষণ কমানো বা রোধ করা সম্ভব। কিছু নিয়ম, কিছু পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগই কমাতে পারে এই বায়ুদূষণ। শুধু স্থানীয়ভাবে ঢাকায় বায়ুদূষণ কমালে কাজ হবে না। এজন্য আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করার বিষয়ে আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে সব দেশের একমত হওয়া প্রয়োজন। এটা না হলে এই অঞ্চলের কোনো দেশের বায়ুদূষণমুক্ত হবে না। তাই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে সরকারি উদ্যোগ দরকার। তাহলেই বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close