শাহনাজ পারভীন
মুক্তমত
ডিপ্রেশন থেকে তরুণদের মুক্তির উপায়
বর্তমান সমাজে তরুণ-তরুণীদের অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হলো ডিপ্রেশন বা মানসিক ব্যাধি। তীব্র বিষণ্নতা থেকে মূলত ডিপ্রেশনের জন্ম। এ ধরনের রোগীরা হতাশা ও বিষণ্নতায় একসঙ্গে ভোগেন। কারো কারো ক্ষেত্রে এই বিষণ্নœতা ক্ষণস্থায়ী আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। ক্ষণস্থায়ী বিষণ্নœতা যদিও তেমন প্রভাব ফেলে না, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা অনেক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, একজন মানুষকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়ই ডিপ্রেশন। তরুণদের সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে করোনাকালে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সিদের ৬১ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন। সব বয়সের মানুষই বিষণ্নœতায় ভোগে তবে শতকরা হিসাবে তরুণদের হার একটু বেশি।
বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশন হয়ে থাকে। ডিপ্রেশনের অন্যতম একটি কারণ হলো কোনো কিছু সহজে মেনে নিতে না পারা। মানুষের জীবনে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই ঘটে, যা তারা কখনোই প্রত্যাশা করে না। জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণে সফল না হলে কিংবা অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হলে তা মেনে নিতে না পারা থেকেই মানুষের মধ্যে বিষণ্নতার সৃষ্টি হয়। আর তীব্র বিষণ্নতা থেকে আমরা ডিপ্রেশনে ভোগী। এ ছাড়া পারিবারিক ভাঙন কিংবা পারিবারিক অশান্তি ডিপ্রেশনের অন্যতম প্রধান কারণ। চোখের সামনে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে মানুষ একপর্যায়ে তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে। এ ছাড়া বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতায় ভোগে। ফলে তারা পড়াশোনায় মনোযোগ হারানোর পাশাপাশি বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে যায়। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে অনেকটাই দূরে চলে যায়। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রেমে প্রত্যাখ্যান কিংবা প্রেমের ভাঙন অধিকাংশ তরুণ-তরুণীরার মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে ওঠে। তারা একটি বিষয়কে ঘিরে নিজেদের আলাদা জগৎ তৈরি করার ফলে সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নœতা বা মানসিক ব্যাধি যা-ই বলি না কেন এটি শারীরিক অসুস্থতার মতোই মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কাজে উদ্যমের অভাব, মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, কোনো কিছু করতে ইচ্ছা না করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায় ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের মধ্যে। তারা দৈনন্দিন দায়িত্বগুলোও সঠিকভাবে পালন করতে পারে না উদ্যমহীনতার কারণে। সারাক্ষণ তীব্র বিষণ্নতায় ভোগার ফলে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যার দিকেও ধাবিত হয়। আবার কেউ কেউ মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে যায়। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত অহংকারের কারণেও ডিপ্রেশনে ভোগে, কেননা এরা তাদের প্রতি নেতিবাচক কোনো কিছু সহজে মেনে নিতে পারে না। অল্পতেই তারা অপমানবোধ করে। কখনো কখনো দেখা যায়, তারা শিক্ষকের শাসনকেও অপমানের চোখে দেখে। ফলে বিদ্যালয়মুখী ভাবটি তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যায়। তারা পড়াশোনায় ছন্দ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের থেকে পর্যাপ্ত যত্ন না পেলেও কেউ কেউ হতাশায় ভোগে। তারা একাকিত্বের জীবন বেছে নেয়। সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। আবার কেউ কেউ ছোটবেলা থেকেই উচ্চাকাক্সক্ষী মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। ফলে যখন তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কোনো কিছু না পায় তখন তারা মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কারণ তারা হার জিনিসটা কখনোই মেনে নিতে পারে না এবং কোনো কিছুর ওপর সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তারা মানসিক সুখ হারিয়ে ফেলে এবং বিষণ্নœতায় ভোগে। কেউ কেউ নিজেদের ছোট মনে করার মাধ্যমে হীনমন্যতায় ভোগে এবং মানসিকভাবে ভেঙে যায়। এ ছাড়া মা-বাবা উভয়ই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারে না। ফলে চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানরা অধিকাংশই মানসিক বিষণ্নœতায় ভোগে। এ ছাড়া নিজেদের সমস্যার কথা কারো সঙ্গে খোলামেলাভাবে প্রকাশ করতে না পারার জন্য তারা ডিপ্রেশনে ভোগে। আর এভাবেই তরুণ সমাজ তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখার থেকে দূরে চলে আসে। যা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
দিনের পর দিন তাদের এ সমস্যা বেড়েই চলছে। তাই আমাদের দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে তরুণদের অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সমস্যাগুলো শুনে ও বোঝে সক্রিয় পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আলাদাভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। যেন শিক্ষার্থীরা সহজেই প্রাণ খুলে তাদের সমস্যা শেয়ার করতে পারে এবং যথেষ্ট সাহায্য পেতে পারে। হাসপাতালগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা স্বল্পমূল্যে প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তার পর্যাপ্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে। বাবা-মাকে তার সন্তানদের জন্য আলাদা সময় বের করে তাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তরুণদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে এবং এতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তরুণরা তাদের অবসর সময়গুলো নেতিবাচক কোনো কাজে ব্যবহার না করে সামাজিক কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারবে। এ ছাড়া মোটিভেশনাল স্পিকারদের তাদের কাজের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। এতে করে অধিকাংশ তরুণ-তরুণীই নেতিবাচক ভাবনা বাদ দিয়ে ইতিবাচক দিকে নিজেদের বদলাতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজগুলো কয়েক মাস পরপর অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির ব্যাপারে আলোচনা সভার আয়োজন করতে পারে। এতে করে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবক সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পথ সহজ হয়ে যাবে।
সব মানুষের সচেতনতাই পারে এ সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি দিতে। একে অপরের সমস্যা শোনা ও বোঝার মাধ্যমে সে অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এ সমস্যা সহজেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ছাড়া সবাইকে নিজেদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"