শাহাদাত হোসেন

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন

এই আস্তে কথা বলো, এটাই চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় বেশির ভাগ পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য হল প্রত্যাবেক্ষকের একমাত্র করণীয়। তাও শিক্ষার্থীদের সামনে গিয়ে নিচু স্বরে বলতে হবে। তাই নকল রুখতে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন আবশ্যক। শুধু চিরকুট দেখে লিখলে নকল হয় না। পাশের পরীক্ষার্থীর থেকে শোনে বা দেখে লিখলেও তা নকলের শামিল। তবে এটা নকল থেকেও মারাত্মক কারণ নকলে একজনের ক্ষতি হয় আর পাশর্^বর্তী পরীক্ষার্থীরটা দেখে বা শুনে লিখলে আশপাশের সবার ক্ষতিসহ হলের পরিবেশও নষ্ট হয়। জাতি সমূলে বিনষ্ট হওয়ার আগেই মিলেমিশে লেখার ট্রেডিশন বন্ধ করতে হবে।

সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকের কোনো আলোচনা হয় না। ফলে মাঠপর্যায়ের কোনো সমস্যাই তারা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন না, আবার সবার সঙ্গে আলোচনা করাটাও সহজ বিষয় না। তাই কলেজ প্রশাসন থেকে আমরা যে মেসেজ পাই সেটাকেই মহামূল্যবান হিসেবে ধরে নেই। শুনলাম ডিসি সাহেবও কি না স্মার্টফোন নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না অথচ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নিজেই স্মার্টফোন নিয়ে রুম পর্যবেক্ষণ করলেন আর বাকিদের কী অবস্থা তা বলাবাহুল্য, এ অবস্থা প্রায় সবখানেই অথচ আমরা সাধারণ শিক্ষকরা নন-স্মার্টফোন ব্যবহারেরও অধিকার পেলাম না। আবার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, কারো খাতা নিয়ে সতর্ক করা যাবে না এবং নিজ জায়গা থেকে সরানো যাবে না। ওপরের দুটি কাজ অবশ্যই পরিত্যাজ্য শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্র্থীদের মানসিকতার কারণে হলের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীরা চুপচাপ আমাদের নির্দেশনা মানবে এটা কাম্য করা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও এখনো আমাদের মানসিকতা জাহিলিয়াত যুগের ন্যায় অর্থাৎ সুযোগ পেলে তা কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। যেখানে আমাদের শাস্তি দিয়েও সঠিকপথে রাখা যায় না সেখানে শাস্তি ছাড়া কীভাবে হলের পরিবেশ ঠিক রাখা যাবে তার বোধোদ্বয় হওয়া উচিত ওপরের মহলের। কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী বহিষ্কার করার ক্ষমতা শিক্ষকের হাতে ন্যস্ত থাকলেও তা ওপরের মহলের অনুমতি ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না, এটা একটা ওপেন সেক্রেট। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হওয়া যাবে না আবার ফোনও ব্যবহার করা যাবে না, তাই শিক্ষার্থী কথা না শুনলে প্রশাসনের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই। আবার ইনফর্ম করলে ব্যর্থতার তোকমা দেওয়া হয় আমাদের। তা ছাড়া পাশাপাশি দুই কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী একে অপরের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিলেও সেখানে তো সোনায়-সোহাগা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে উভয় কেন্দ্রের মধ্যে। আবার এক উপজেলার পরীক্ষার্থীদের আরেক উপজেলায় দিলেও সেখানেও ভীষণ রকম ক্ষতি হবে শিক্ষার্থীদের। তা ছাড়া শিক্ষকদের দুর্বল চাকরি ব্যবস্থা ও আর্থিক দৈন্যতা শিক্ষকদের সৎ-সাহস নিম্নগামী করে তোলে।

ফলে আমাদের মানসিকতা আর পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন ছাড়া এই ট্রেডিশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। বহু জাতিগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত বাঙালি জাতি স্বভাবতই আত্মকেন্দ্রিক। আমরা সবার আগে নিজেকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। এই নীতি সমাজের ত্যাগী রাজনীতিবিদ থেকে শুরু থেকে সাধারণ আমণ্ডজনতা পর্যন্ত বিস্তৃত। তা ছাড়া দূরদর্শিতার অভাবে আমরা ভবিষ্যতের ক্ষতির চিন্তা বাদ দিয়ে বর্তমানের সুবিধাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাপ্ত নম্বরকে প্রাধান্য দেওয়ায় পরীক্ষা হলের পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, কেননা যে করেই হোক পরীক্ষায় উচ্চ নম্বরপ্রাপ্তি আবশ্যক। তাই শুধু কাগুজে বাঘ হওয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ শুধু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই পরীক্ষা পদ্ধতি এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেখানে চাইলেও কেউ নকল করতে পারবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি ও চাকরি ব্যবস্থায় উচ্চ নম্বরের প্রয়োজনীতাও বন্ধ করতে হবে। মাদরাসা, কারিগরি ও সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডে এ বছর প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে। যেখানে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতি বেঞ্চে ১ জন করে বসানো সম্ভব নয়। এইচএসসিতে হয়তো ১৬ থেকে ১৭ লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেবে। তাই বাহ্যিক প্রশাসনের ওপর পরীক্ষা গ্রহণের ভার ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে বোর্ডগুলোকে নিজেদের পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে শিক্ষার্থীদের। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতি বোর্ডকে বছরে এসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে ৩.৫ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি মাসে ১টি সেগমেন্ট চালু করলে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে। আমাদের বর্তমান আর্থিক সামর্থ্যরে কাছে এই আয়োজন কিছুই না। তাই প্রয়োজন শুধু স্বদিচ্ছার। সে ক্ষেত্রে বোর্ডগুলোকে ঢেলে সাজাতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সেখানে পরীক্ষা কেন্দ্র চালু ও পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি ডিজিটাল সিস্টেমে নেওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে। প্রতিবার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসনের বিপরীতে পরীক্ষার্থী সংখ্যা বেঁধে দিলে সবাই নিজ নিজ স্বার্থে সময়মতো রেজিস্ট্রেশন করে পরীক্ষায় অংশ নেবে। সিলেবাসের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতি বিষয়ের জন্য ৫০-এর অধিক সেট প্রশ্ন করা যেতে পারে। প্রতি প্রশ্নে অবশ্যই তিন ধরনের প্রশ্ন রাখা বাঞ্ছনীয়। অতিগুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ ও কম গুরুত্বপূর্ণ যাতে সাধারণ, মেধাবী ও অতি মেধাবী শিক্ষার্থী বের করা সম্ভব হয়। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর সামনে কম্পিউটারের মনিটর ও প্রশ্নপত্র ইলেকট্রনিক লটারির মাধ্যমে সিলেক্ট করার জন্য লটারির সুইচ রাখতে হবে। পরীক্ষার্থী আসন গ্রহণ করার লটারির সুইচের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র গ্রহণ করবে এবং তা তৎক্ষণাৎ তার হার্ডকপি প্রিন্ট আকারে বের করার ব্যবস্থা থাকবে। পরীক্ষা শেষে প্রশ্নটি উত্তরপত্রের সঙ্গে সংযোজন করে জমা দেবে। পুরো ব্যবস্থাটি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করতে হবে, এতে হল পর্যবেক্ষকের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে এবং বোর্ডগুলোকে আলাদা পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা শিডিউল অনুযায়ী স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করানো যাবে, তবে নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে বোর্ডের হাতে ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট সেশন ঠিক করে দেবে বোর্ডগুলো। নির্ধারিত সময় শেষে বোর্ড অনলাইনে ফলাফল দিয়ে দেবে, এতে করে ফলাফল প্রস্তুতিতে বোর্ডের ওপরও চাপ কমে আসবে। একসঙ্গে সবার পরীক্ষা গ্রহণ করার ফলে শিক্ষকরা উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না। বছরব্যাপী পরীক্ষা নিলে শিক্ষকরা উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবেন, ফলে অবমূল্যায়নের সম্ভাবনা কমে যাবে। জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যতা অবশ্যই দূর করতে হবে।

নকল রুখতে উচ্চশিক্ষা লাভের দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরি ব্যবস্থায় যেভাবে শিক্ষার চরম অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তাতে শুধু পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে নকল রুখা সম্ভব নয়। পিয়ন পদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক পাস চাওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেখানে সর্বনিম্নপর্যায়ের চাকরির জন্য মহাবিদ্যালয়ের পাঠ শেষ দরকার সেখানে সার্টিফিকেটের জন্য হাহাকার তো চলবেই। বেতনবৈষম্য দূর করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। কর্মসংস্থানভিত্তিক সিলেবাসের আধুনিকায়ন করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থী নিজস্ব লাইনে পড়াশোনা করবে, ফলে শিক্ষার্থী অল্প সময়েই দক্ষ হয়ে উঠবে। নতুন শিক্ষা কারিকুলামে ১২ বছর সবাইকে একই সিলেবাসে শিক্ষা দেওয়া হবে, যা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব কি না তা গবেষণার দাবি রাখে। আজব সিলেবাসে ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক ও বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের একই সিলেবাসের আইসিটি পড়ানো হয় অথচ মানবিক শাখার জন্য যে পর্যায়ের আইসিটি যে জ্ঞান প্রয়োজন তার চেয়ে উন্নতমানের প্রযুক্তিগত আইসিটি জ্ঞান প্রয়োজন বিজ্ঞান শাখার জন্য ।

নৈতিক শিক্ষায় নকল রুখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সরকারসহ বিভিন্ন এনজিও ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গণসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। টেলিভিশন মিডিয়ায় এর কুফল নিয়ে বিভিন্ন নাটিকা প্রচার করা হলে ভালো কাজ হবে। বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে হবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান আরোহণ, উচ্চ নম্বর নয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে জুমার নামাজে আলোচনা করলে ভালো ফলাফল আসবে নিশ্চিত, কেননা সবাই জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর-পরবর্তী সময়ে আমাদের অবস্থান হলেও বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের কোনো অবদান নেই। আমাদের আন্তর্জাতিক মানের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

নেই, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। তাই শিক্ষাব্যবস্থার ফাউন্ডেশন শক্ত করার জন্য সব ধরনের বাধা দূর করতে সু-নিপুণ হাতে।

লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close