অলোক আচার্য
মুক্তমত
মালয়েশিয়ার নির্বাচন ও মাহাথির
মালয়েশিয়ায় মাত্র শেষ হলো নির্বাচন। নতুন প্রধানমন্ত্রীও শপথ নিয়েছেন। বলা যায় এ নির্বাচন ছিল ঘটনাবহুল। এই নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এজন্য কিছুটা সংকট তৈরি হয়। তৈরি হয় ঝুলন্ত পার্লামেন্টের পরিস্থিতি। নির্বাচনে বড় তিনটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ২২২ আসনের নির্বাচনে কেউই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় নির্বাচনের পরও সরকার গঠনে একটু সময় লেগে যায়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপন (পিএইচ) জোট সর্বোচ্চ ৮২টি আসব পায় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) ৭৩টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে। ঘটনাবহুল নির্বাচনের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। দীর্ঘ ২৫ বছর তাকে এই পর্যায়ে আসতে অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর আগে ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯৩ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন তিনি। মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে তৈরি বিভেদে তিনি প্রায় রাজনীতি থেকেই ছিটকে পড়েন। যার হাতে ছিটকে যান রাজনীতি থেকে তার হাত ধরেই আবারও তার প্রত্যাবর্তন ঘটে। তারা একসঙ্গে জোটও গড়েন। এই সেই আনোয়ার ইব্রাহিম যার সঙ্গে মাহাথিরের সম্পর্ক ভালো-মন্দ দুই-ই ছিল। একসময় তার সঙ্গে জোটও করেছিলেন আবার তিনি থাকতে আনোয়ার ইব্রাহিম গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। জীবনে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে কাটান। তবে ২০১৮ সালে মাহাথির মোহাম্মদ আনোয়ারের সঙ্গে নতুন জোট গড়েন। প্রতিশ্রুতি দেন যে ক্ষমতায় গেলে তার রাজক্ষমার ব্যবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব পদ ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। ফলে আনোয়ার ইব্রাহিমেরও প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়ে ওঠেনি।
মাহাথির মোহাম্মদ সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদদের এক অনুসরণীয় নাম। তার ক্যারিসম্যাটিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় মালয়েশিয়া বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে ওঠে। আধুনিক মালয়েশিয়া যার হাত ধরে গড়ে উঠেছে, আজ মালয়েশিয়াকে বিশ্ব যে চোখে সমীহ করছে তার পেছনের কারিগর এই মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি সেখানকার রাজনীতির মহীরুহ। একটি বিস্ময়কর নাম যার হাত ধরেই আজকের মালয়েশিয়া গড়ে উঠেছে। তিনিই এশিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর দীর্ঘ ২২ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি মালয়েশিয়াকে গড়ে তোলেন আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে। কৃষির পাশাপাশি তিনি শিল্প ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেন। বিশ্বের প্রত্যেকেই তার অবদান স্বীকার করে নেয় এবং নেতৃত্বেও প্রশংসা করে। কিন্তু সবারই কি উত্থান-পতন থাকে? তাই হবে হয়তো। নাহলে মাহাথির মোহাম্মদের মতো একটি নাম কেন এভাবে পরাজিত হবেন? অনেকেই বলছেন তার রাজনীতি থেকে এই বয়সে দূরে থাকাই ভালো ছিল। তবে রাজনীতির তো বয়স নেই তাই এই প্রায় শতবর্ষী বয়সেও তিনি রাজনীতিতে ছিলেন। আজকের মালয়েশিয়া একসময় ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। তারপর যখন সেই শাসন থেকে মুক্তি হয় তখন দেশটির হাল ধরেন মাহাথির মোহাম্মদ। মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম হয় ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত মালয়ের কেদাহ অঞ্চলের সেতার নামক গ্রামে সাধারণ এক স্কুল শিক্ষকের ঘরে। তিনি ১৯৪৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে রাজনীতিতে আসেন। বয়সটা তরুণ হলেও তিনি কাজ করেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতো। এর পরের গল্পটা শুধুই উত্থানের। মালয়েশিয়ার একটি সাধারণ পরিবার থেকে ওঠে আসার গল্পটা তার একান্তই নিজের। স্কুল-কলেজ শেষ করে ১৯৪৭ সালে তিনি ভর্তি হন সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে এমবিবিএস শেষ করে তিনি প্রথমে একটি সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। তখনও বোঝা যায়নি এই মানুষটিই এক দিন মালয়েশিয়ার ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। তবে শেষটা যে এভাবে হবে সেটা হয়তো কেউ ভাবেনি। সরকারি হাসপাতাল থেকে চাকরি ছেড়ে তিনি প্রাইভেট ক্লিনিক খোলেন। অবশ্য সরকারি চাকরি করলে রাজনীতির মাহাথিরকে আজ আমরা হয়তো পেতাম না। সেটা ছিল মালয় বংশোদ্ভূত একমাত্র কারো হাসপাতাল। এটা হলো তার শুরুর দিককার ইতিহাস। ১৯৬৯ সালে দল থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন মালয় সম্প্রদায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায়। পার্লামেন্টের আসন হারান তিনি। ১৯৭০ সালে তাকে ইউএমএনওতে ফিরিয়ে নেওয়া পার্লামেন্টে সদস্য পুনর্নির্বাচিত হন। একই বছর তাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৭৬ সালে মাহাথির উপপ্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮১ সালে জুনে তিনি দলটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই বছরের জুলাইয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তার নির্বাচনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিয়ে বিশ্বজুড়েই বিশ্লেষণ হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে বিজয়ী হয়ে দেখিয়ে দেন রাজনীতির বয়স লাগে না। সে সময় নাজিব রাজাককে পরাজিত করেন তিনি। সেটি ছিল তার অসাধারণ প্রত্যাবর্তন। কিন্তু মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে জোটটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে মাহাথির মোহাম্মদ পদত্যাগ করেন। মাহাথির এবং আনোয়ারের পথ আবারও আলাদা হয়ে যায়। তারপর তিনি ফিরতে পারেন এমনটা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি। সবাইকে চমকে দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘোষণা করেন।
ড. মাহাথিরের নেতৃত্বে একটি নতুন জোট গঠিত হয়। সেই জোট নিয়ে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সেই মানুষটি মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে এভাবে পরাজিত হলেন। যেখানে তার দলের সবার জামানত পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। তার নিজের আসনেও তিনি হেরেছেন। সেখানে তিনি পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার পরাজয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। বিখ্যাত গণমাধ্যম আলজাজিরার মতে, নির্বাচনে হারের পেছনে মাহাথিরের বয়স সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমটি বলছে, শেষ পর্যন্ত বয়সই যে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল, তা প্রমাণিত। তা ছাড়া তার ক্ষমতায়নের সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে। তার কিছু রাজনৈতিক ভুলও ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যে বদলায় সেটাও হয়তো তিনি অনুমান করতে পারেননি। আগের সময়রে নির্বাচনের সঙ্গে এই নির্বাচনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। আগেরবার তিনি সদ্য দায়িত্ব নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। এবার করেছিলেন নতুন জোট। এই পরাজয়ের পর এই বয়সে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরবেন কি-না সেটাও প্রশ্ন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"