রেজাউল করিম খোকন
দৃষ্টিপাত
সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিরোধ করতে হবে
দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম বেড়েই চলছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। মানিলন্ডারিং, অর্থপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউয়ের কাছে রিপোর্ট করে, যা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) হিসেবে পরিচিত। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যেকোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। এসটিআর আসা মানেই অপরাধ সংঘটিত হওয়া নয়। এসব অপরাধ ঠেকানো ও অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য এসটিআর রিপোর্টিং চালু করা হয়েছে।
এ রিপোর্ট পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করতে পারে। গেল ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১টি। অর্থাৎ এ সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে আর্থিক খাতে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির কারণে বিদায়ি আর্থিক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনে এগিয়ে আছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩৩টির রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত জরুরি। এরপর যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ মেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে দেশের ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার বিষয়ে রেটিং প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ না করলেও কতগুলো ব্যাংকের প্রতিরোধ সক্ষমতা কতটুকু তা প্রকাশ করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ‘শক্তিশালী বা স্ট্রং’ মান পায়নি কোনো ব্যাংক।
এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভার ইনভয়েসিং ঠেকাতে পারলেও বন্ধ করা যায়নি আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি। গত অর্থবছরে সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে পুলিশ, গোয়েন্দা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। অর্থপাচারে কেউ কেউ আমদানি পণ্যের দাম ২০ থেকে ২০০ শতাংশ বেশি দেখিয়েছেন আবার গাড়ি আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। ডিজিটাল হুন্ডির এই অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বেশ কিছু পরিবেশক ও এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ।
সন্দেহজনক লেনদেন এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্য থাকলেও কী পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে, আমদানি করা পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। তিনি এ-ও বলেছেন, ডলার দেশের বাইরে চলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুরূহ ব্যাপার। মানিলন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলায় বেশ কটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে বড় বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি বাড়িয়েছে, এখন আর ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে না। একইভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং, অর্থাৎ দাম কম দেখিয়ে আমদানি বা রপ্তানি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে।
দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। তখন সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলা হয়েছিল, সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা রেখেছে, তা বের করা হবে। কেবল বেরই করা হবে না, দেশেও ফিরিয়ে আনা হবে। জাতীয় সংসদকে জানানো হয়, সরকার আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে। আর পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের সেই বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতির পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থপাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ ফেরত আনা তো দূরের কথা, সুইস ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই বাংলাদেশের নেই। অথচ বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কী পরিমাণ অর্থ আছে, তা প্রথম জানা যায় ২০০৪ সাল থেকে। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে লেখালেখি শুরু হয়েছিল ২০১৪ থেকে। রিপোর্ট প্রকাশের পরে এ নিয়ে লেখালেখি হলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কয়েক বছর ধরে অবশ্য কথা বলার সুর পাল্টে গেছে। এখন একটাই কথা, এ অর্থ বাংলাদেশ থেকে যায়নি। আসলে কোথা থেকে গেছে, কার অর্থ গেছে, তা জানার কোনো সুযোগই বাংলাদেশের নেই, যা অন্য অনেক দেশের আছে।
দেশ থেকে অর্থপাচারের ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে অর্থপাচার হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে অর্থপাচারের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুশাসন ইত্যাদি। এখনো দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। অনেকে নানা রকম দুর্নীতির মাধমে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করছে। এসব টাকা দেশের ব্যাংকে রাখলে জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হতে পারে। এমন আশঙ্কায় দেশের বাইরে অর্থ পাঠিয়ে নিরপদ থাকতে চাইছেন তারা। সুইস ব্যাংকে গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখার কারণে সেখানকার ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অসৎ দুর্নীতিবাজ মানুষের উপার্জিত অবৈধ অর্থের জমা রাখার নিরাপদ জায়গা হিসেবে পরিচিত। দেশে এখন প্রায় ১ লাখ কোটিপতি রয়েছে। এদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা বলয়ের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে কালোটাকার মালিক থাকা অস্বাভাবিক নয়।
সরকারের উচিত হবে যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এদের অর্থের উৎস সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে সুশাসন, সুসংগঠিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সর্বোপরি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা থাকলে অর্থপাচার অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। সাধারণভাবে বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই। অপরদিকে তারাই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। কী কারণে এটি হচ্ছে তা বোঝা দরকার। এ টাকা পাচারের কয়েক কারণ হতে পারে। যেমন, তারা বিনিয়োগের পরিবেশ পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে না। অথবা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই। সামগ্রিকভাবে কেন উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না, সেটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। আবার যদি এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে এটি বাড়তে থাকবে। এ অবস্থার উত্তরণে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার শুধু দেশের অর্থনীতিরই ক্ষতি করে না, দেশটির উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশে সেই অর্থপাচার আজ উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। বাংলাদেশেও মুদ্রাপাচার রোধে কিছু সংস্থা কাজ করছে বটে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল সন্তোষজনক নয়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, কলাম লেখক
"