মাজহার মান্নান

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

নতুন শিক্ষাক্রম এবং বাস্তবতা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ঘটা করে পালন করেছি। জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী আমরা উদযাপন করেছি। পদ্মা সেতুর মতো একটি মাইলফলকও আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। কিন্তু এখনো একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাক্রম দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর শিক্ষা খাতে বহুমাত্রিক পরিবর্তন হয়েছে সত্য কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। কোনো পদ্ধতি যখন চালু করা হয় তখন মাঠপর্যায়ে প্রচুর জরিপ এবং গবেষণার প্রয়োজন হয়। জরিপ ও গবেষণায় ঘাটতি থাকলে সুফল পাওয়া যায় না। শিক্ষা খাতে বহুবার সংস্কার হয়েছে কিন্তু সেটা যথাযথ জরিপ আর গবেষণালব্ধ না হওয়ার কারণে সেটাতে পূর্ণাঙ্গ সফলতা আসেনি। আর তাই নতুন করে শিক্ষাক্রম তৈরির প্রয়োজন হলো, যা ২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে।

কিন্তু এর দুর্বল দিকগুলোকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এবং বাস্তবে এর প্রয়োগ কতটুকু সম্ভব সেটাও ভাবতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের অনেকগুলো বিষয় আছে যথার্থ এবং যেটা খুব প্রয়োজন ছিল এ মুহূর্তে। তবে কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন আছে। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই, পরীক্ষা পদ্ধতি ও শ্রেণিকার্যক্রম নিয়ে মানসম্মত কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জিপিএভিত্তিক ফলাফলে পরিবর্তন আসছে। আগে পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল নির্ধারিত হতো প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ এবং তৃতীয় বিভাগে। পরে জিপিএ পদ্ধতি চালু করা হয়। শুরুতে জিপিএ পদ্ধতির ফলাফলে বেশ সন্তুষ্টি ছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সেটা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। কারণ জিপিএ ৫ নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

মনে হচ্ছিল পড়ালেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো জিপিএ ৫ অর্জন। কিন্তু এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় গ্রাম ও শহর অঞ্চলের শিক্ষা বৈষম্য বাড়তে থাকে। নতুন শিক্ষাক্রমে জিপিএ-ভিত্তিক ফলাফল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের আরেকটি ভালো দিক হলো সৃজনশীলের আদলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতির অবসান এবং গতানুগতিক বহুনির্বাচনী প্রশ্নের আমূল সংস্কার। কাঠামোবদ্ধ সৃজনশীল প্রশ্নে প্রায় দেড় যুগ চলে গেল কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুফল এলো না। সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার সেটা করা সম্ভব হয়নি। এমনকি প্রকৃত সৃজনশীলের আদলে পাঠ্যবইও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মোটকথা, একটা লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছিল শিক্ষাক্রমে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে শিখনকালীন ও সামষ্টিক দুটি ধাপে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামষ্টিকটা হবে জাতীয়ভাবে। শিখনকালীন মূল্যায়নের বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে। শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে বছরব্যাপী ধারাবাহিকভাবে। ধারণাটি চমৎকার। কিন্তু দেশের বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। উন্নত ও শিক্ষায় অগ্রগামী দেশগুলোতে শিখনভিত্তিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিক মূল্যায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং তারা এ ক্ষেত্রে সফল। তাদের সফলতার পেছনে মূল কারণ হলো শিক্ষকদের মর্যাদা এবং উচ্চ বেতন থাকা। এমনকি শিক্ষকরা সেখানে কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত হোন না। কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপট ঠিক এর উল্টো। আমাদের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যদা ও বেতন দুটিরই দৈনদশা। বেতন কাঠামো দুর্বল হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে কোচিং মনোবৃত্তি প্রকট হয়ে ওঠে। তাই নতুন শিক্ষাক্রমের এই শিখনভিত্তিক মূল্যায়ন শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদে পড়তে পারে। সেটা হবে আরেকটি নতুন জঞ্জাল।

শিখনভিত্তিক মূল্যায়নের সম্পূর্ণ নম্বর থাকবে শিক্ষকদের হাতে। যারা প্রাইভেট বা কোচিং করতে পারবে না তারা এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারে। নতুন শিক্ষাক্রমে বলা হয়েছে, পরীক্ষা শুধু কাগজে-কলম নির্ভর হবে না, এটির একটি প্রায়োগিক দিক থাকবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগসহ নানা বিষয় থাকবে। এই মূল্যায়ন হবে তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রারম্ভিক স্তর, অন্তর্বর্তী স্তর, পারদর্শী স্তর। মূল্যায়নটা হবে যোগ্যতাভিত্তিক। সবই সুন্দর আয়োজন। কিন্তু এই সুন্দর আয়োজনের যারা কারিগর তাদের আমরা কতটুকু প্রস্তুত করতে পেরেছি? শিক্ষকদের উপযুক্ত না করে বা যথার্থ প্রশিক্ষণ না দিয়ে মূল্যায়নের এই নবপদ্ধতিকে কতটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেওয়া যাবে সেটাই বড় প্রশ্ন।

২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে বলে জানা গেছে। প্রথাগত পরীক্ষার হার কমিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের দিকে অধিক নজর দিতে হবে। কিন্তু শিক্ষায় দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, গাইড ও নোটবইয়ের দৌরাত্ম্য, শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ না করে এবং পাঠ্যবইয়ের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না করে কীভাবে শুধু শিখনভিত্তিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি আদর্শ শিক্ষাক্রম গড়ে তোলা সম্ভব তা বোধগম্য নয়। অনুকূল পরিবেশ না দিয়ে শুধু বৃক্ষবীজ বপন করলেই তো আর ফল পাওয়া যায় না। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার যে প্রচণ্ড চাপ ছিল সেটা থেকে তারা অনেকটাই মুক্তি পাবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রথাগত পরীক্ষা হবে না। এটা দারুণ একটি পদক্ষেপ। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনভিত্তিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। অন্য পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক বা বছরব্যাপী হবে। এটিও দারুণ উদ্যোগ। কেননা ১০টি বিষয়ের শিখনভিত্তিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে গেলে হিতে বিপরীত হতো। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সামষ্টিক মূল্যায়নের নম্বর রাখা হয়েছে ৭০ আর শিখনভিত্তিক ৩০। তবে সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রশ্ন পদ্ধতির ধরন সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। সামষ্টিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই নতুনত্ব আনা প্রয়োজন। পাঠ্যবইয়ে অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্ন ব্যাংকজুড়ে দেওয়ার বিকল্প দেখছি না। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইমুখী করতে হলে অবশ্যই প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে দিতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা খাতে লাগামহীন দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে কোনো কিছু করেই ফল আসবে না। তাই শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে। একটি দেশের মানসম্মত শিক্ষার ওপর নির্ভর করে সে দেশের সামগ্রিক তথা প্রকৃত উন্নয়ন। শিক্ষা লাভ করে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে দক্ষ করে তোলে। কিন্তু সম্প্রতি যে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে সেটাকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। কেন দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাবিমুখতা তৈরি হচ্ছে সেটা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণার সংবাদ আমার জানা নেই। কিন্তু নীরবে একটি স্থায়ী সংকট তৈরি হচ্ছে, যেটা শুভকর বলে মনে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সবকিছু ভালো মনে হলেও আসলে তা কতটুকু মঙ্গলজনক সেটা ভাবার বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রম পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করতে হলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। ১. ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে ভারসাম্য আনা, ২. প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া, ৩. শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক এবং উন্নত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, ৪. শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা, ৫. বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অযথা হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, ৬. প্রশ্ন ব্যাংকসহ মানসম্মত পাঠ্যবই তৈরি করা এবং গাইড ও নোটবইয়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া, ৭. শুধু পাসের হারের ভিত্তিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন না করা, ৮. দুর্নীতি বন্ধ করা, ৯. প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা, ১০. শিক্ষকদের জন্য গবেষণার পথ প্রশস্ত করা, ১১. শিক্ষক রাজনীতি ও দলাদলি বন্ধ করা, ১২. সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা, ১৩. পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, ১৪. নৈতিক শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, ১৫. সিলেবাস কমিয়ে আনা ও প্রশ্নের প্যাটার্ন পরিবর্তন করা, ১৬. শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত রাখা।

আমাদের দেশে সবচেয়ে কম মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন। কেননা মেধাবীরা এখানে কোনো চার্ম খুঁজে পায় না। উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ তারা এই পেশায় খুঁজে পান না। বেতন কম, পদোন্নতির সীমিত সুযোগ, বদলি, সামাজিক মর্যাদাসহ নানা কারণে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চান না। আর মেধাবীরা যদি এই পেশায় না আসেন তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। বীজ ভালো না হলে ফসল ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। তাই স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নিশ্চিত করে মেধাবীদের এই পেশায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করে দেশের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close