নুর মোহাম্মদ
দৃষ্টিপাত
বইবিমুখতা তরুণ সমাজের অবক্ষয়
জ্ঞানের রহস্যময় ভাণ্ডার হলো বই। বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বই মানুষকে হাসাতে পারে, সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। বই মানুষকে হাসতে, জানতে, বুঝতে শেখায় ও মনের কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করে। মানবজীবনের সুন্দর অভ্যাসগুলোর মধ্যে পাঠাভ্যাস অন্যতম। মানুষ বইপাঠের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। যুগে যুগে বই এনেছে ত্যাগের দীক্ষা, সত্য ও সুন্দরের সাধনা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের এবং পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, বর্তমান সমাজ বিশেষ করে আমাদের মতো তরুণরা বই পড়া থেকে দিন দিন নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে।
একটা সময় ছিল যখন অধিকাংশ তরুণের অবসর সময় কাটত বই পড়ে। নতুন নতুন বই পড়ে তারা জ্ঞানের সাগরে ডুবে থাকত। তারা জীবনের আনন্দ, সুখণ্ডদুঃখগুলোকে বইয়ের সঙ্গেই ভাগাভাগি করে নিত। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের সবুজ চত্বরে কিংবা বন্ধুদের চায়ের আড্ডায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকত বই। প্রতিযোগিতা হতো বই পড়া নিয়ে। তাহলে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ কী?
বেশ কয়েক মাস আগে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এ রকম, ‘পাবলিক লাইব্রেরি : বিমুখ পাঠক ফেরাতে কী করছে কর্তৃপক্ষ?’ সেখানে বলা হয়েছিল বিগত দশকে বাংলাদেশের পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে তুলনামূলক পাঠকের আনাগোনা কমে গিয়েছে। এ রকম বিভিন্ন সংবাদ নিত্যনৈমিত্তিক দেখা যায়। আবার এসবের কারণ খুঁজতে গিয়ে পাঠক কমে যাওয়ার নানামুখী কারণ খুঁজে বের করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম যেটি সেটি হলো পাঠকের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া। এ ছাড়া লাইব্রেরিগুলোর করুণ অবস্থা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সহজলভ্য, অবসর সময়ের অভাব, সিলেবাসকেন্দ্রিক লেখাপড়ার চাপ এবং আরো বিবিধ বিষয় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ তো গেল ভিন্ন বিষয়, যেখানে সামগ্রিক পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় যেহেতু ‘তরুণ সমাজের পাঠবিমুখতা’ তাই এ প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক।
তরুণ সমাজের পাঠবিমুখতা বা বইবিমুখতার প্রধান কারণ হিসেবে মোটা দাগে যে বিষয়টি বলা হয় তা হচ্ছে, ‘তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার’। ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন খুব সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। তরুণ সমাজ এখন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, বিভিন্ন অনলাইন গেম যেমন পাবজি, ফ্রি ফায়ার খেলে তাদের মূল্যবান সময় পার করছে। এর ফলে বই পড়া কমেছে, কমেছে বই পড়ার উপযোগিতা। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিই এখনকার তরুণ-যুবসমাজের নিত্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি যে ব্যাপকভাবে তরুণ সমাজের অবক্ষয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে একটি ভয়ংকর বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে কথা বলা যাক। আমেরিকা এবং সুইডেনের কিছু খ্যাতিমান বিজ্ঞানী বর্তমান প্রজন্মের বইবিমুখতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেছেন তারা। তা হলো, অতিমাত্রায় অ্যান্ড্রয়েড ফোনের আসক্তি শিশু-কিশোরদের স্থূলতা রোগ এবং মস্তিষ্কজনিত খারাপ সিনড্রোমে আক্রান্ত করছে। ফলে বাচ্চারা ক্রমাগত বিষণ্নতায় ভুগছে এবং স্বার্থপর রূপে বেড়ে উঠছে। আর এভাবেই তারা স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে দিয়ে যান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে।
বইবিমুখতার এই প্রধান কারণটি ছাড়াও আরো একটি অন্যতম বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে ‘পাঠ্যমাধ্যম’। বর্তমান সময়ে নানা ধরনের বই এবং তথ্যাদি অনলাইনে পিডিএফ আকারে পাওয়া যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো দিক। কেননা মানুষজন চলতি পথে কিংবা অফিসে কাজের ফাঁকে ফোন বের করেই যেকোনো প্রয়োজনীয় তথ্য পড়ে নিতে পারছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এও শোনা যাচ্ছে যে, প্রিন্টিং শিল্পগুলো আর অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা, লোকজন ইন্টারনেটের বদৌলতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট কিংবা পিসি ব্যবহার করেই বইয়ের সব কাজ করতে পারবেন। এই উন্নয়নগুলো আমাদের জন্য যেমনিভাবে আশীর্বাদস্বরূপ, ঠিক তেমনিভাবে তরুণ সমাজের ধ্বংসেরও অন্যতম কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ আমরা করোনা মহামারিকালীনের কথা চিন্তা করতে পারি। করোনা মহামারিতে যখন দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল তখনই শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদানের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই বাধ্যতামূলক ইন্টারনেট এক্সেসের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় নিজস্ব স্মার্টফোনের। অভিভাবকরাও অনেকটা বাধ্য হয়েই ছোট শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। কিন্তু এতে ফলাফল হিতে বিপরীত ঘটে যায়। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে শিক্ষার নাম করে মূলত ইন্টারনেটের বিশাল সমুদ্রে ডুবে যায়, বিভিন্ন ধরনের গেমাসক্তি ধরে যায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে। আর এতে করে তারা পাঠ্যবইয়ের চেয়ে অনলাইনেই বেশি সময় দেওয়া শুরু করে। ঠিক এভাবেই বিগত ২ বছরে সর্বাধিকসংখ্যক তরুণ-তরুণী অবক্ষয়ের পথ বেছে নিয়েছে- এ কথা প্রতিটি পাঠকমাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।
উপরোক্ত বর্ণিত কারণসমূহ ছিল শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাব। এগুলো ছাড়াও তরুণ সমাজের বইবিমুখতার আরো নানান কারণ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হলো :
সামগ্রিকভাবে ‘বই পড়া’ বলতে মূলত সৃজনশীল লেখাপড়ার প্রতি বিষয়টি বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের বাইরেও ঠিক কতটা অতিরিক্ত বই পড়ছে, ঠিক সেটাই। আবার ‘বইবিমুখতা’ বলতে ঠিক এর বিপরীত বিষয় অর্থাৎ এই সৃজনশীল লেখাপড়ার প্রতি অনীহার বিষয়টি বোঝানো হয়। আর আমাদের এবং তরুণ প্রজন্মের মূল ঘাটতিটা ঠিক এখানেই। কেননা আমরা পাঠ্যবইটা বাধ্য হয়ে পড়লেও বাইরের বই পড়াটা বোঝা মনে করা হয়। অবশ্য এই দায়ভার শুধু এই প্রজন্মেরই নয়, এর পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেমন :
প্রথমত. প্রমথ চৌধুরীর একটা বক্তব্য আছে এ রকম- ‘আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটের ওপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, সে দুই-ই বাধ্য হয়ে অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে এক রকম নেই বললেই চলে, কেননা সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না’। প্রমথ চৌধুরীর এ বক্তব্য আর আমাদের বাস্তব সমাজের অবস্থা ঠিক একই। কেননা আমাদের শিক্ষাগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য শুধু অর্থোপার্জন করা, জ্ঞান বৃদ্ধি নয়।
দ্বিতীয়ত. শিক্ষার্থীদের ছোটবেলায়ই শিক্ষার ভুল উদ্দেশ্য শেখানো হয়। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার জন্য তাদের বলা হয় ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চরে সে’। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের বিকাশ করা, চাকরি বা শুধু জ্ঞানার্জন নয়’। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য যে আমাদের বই পড়তে হবে তা শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় না। ফলে যাদের মধ্যে পড়ার সামান্যতম আগ্রহও রয়েছে তারা শুধু পাঠ্যবইটুকুই পড়ে ক্ষান্ত থাকে। সৃজনশীলতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করতে পারে না।
তৃতীয়ত. আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং শিক্ষকরাও নির্দিষ্ট কিছু সিলেবাসের গ-ি পেরিয়ে জ্ঞানের বিশাল জগতে শিক্ষার্থীদের বিচরণ করাতে চান না বা করান না। ফলে শিক্ষার্থীরাও ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানের বিশাল সমুদ্রে বিচরণ করার সুযোগ না পেয়ে ধীরে ধীরে এই ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থত. সৃজনশীল মনন গড়ে তোলা, সাহিত্যচর্চা, গবেষণা ইত্যাদি কাজগুলোকে আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করতে জানি না। যে কারণে আমাদের বিশ্বমানের সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী, গবেষক তৈরি হয় না। কেননা তরুণ প্রজন্মকে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয় না।
সর্বোপরি পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কোথাও সৃজনশীল সাহিত্যপাঠের অনুকূল পরিবেশ না থাকাই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে পাঠবিমুখ জাতিতে পরিণত করেছে।
আমরা জানি ‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। সুতরাং, এখনকার প্রজন্ম কীভাবে বেড়ে উঠছে তার প্রভাব একসময় রাষ্ট্রের ওপর অবশ্যই পড়বে। আমরা দেখেছি আমাদের তরুণ প্রজন্ম কীভাবে দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। এই প্রজন্মকে এহেন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ এবং প্রয়াস।
আমরা এও খুব ভালো করেই জানি যে, একটি সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে বইপাঠ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। লেখকদের মননশীল, বৈচিত্র্যময় এবং রুচিসম্মত লেখনীর মাধ্যমে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকম-লী শিক্ষার্থীদের বইপাঠের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলবেন। নেট জগতের বাইরেও বাস্তব জীবনে তরুণ প্রজন্মকে একটি আনন্দময় জগৎ তৈরি করে দিতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে জ্ঞানচর্চা করতে পারবে। তাহলেই এই সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
তাই আসুন, এই বইবিমুখ প্রজন্মকে ফিরিয়ে আনার জন্য বই পড়াকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিই। নিজে বই পড়ি, অন্যকে বই পড়ায় উৎসাহিত করি। আমাদের সবার স্লোগান হোক, ‘বই পড়া হয়ে উঠুক একটি সর্বজনীন বিষয়, শুধু চাকরি বা পরীক্ষা পাসই উদ্দেশ্য নয়’।
লেখক : শিক্ষার্থী
ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"