রেজাউল করিম খোকন

  ৩০ নভেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কিছু সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, আগামীতেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকগুলোয় জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। সন্দেহ নেই, আলোচ্য ঘোষণা জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগের কিছুটা প্রশমন ঘটাবে কিন্তু এতে কি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতার অবসান ও সমস্যার সমাধান হবে? সহসা তেমনটি হওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এবং এটি ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা, গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যাংক আইনের ঘন ঘন পরিবর্তন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও সুদের হার স্থির করে রাখা প্রভৃতি কারণে ব্যাংক খাত নিয়ে জনমনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা রয়েছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারা ও বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের নতুন করে ফাইল খোলা-বন্ধের মতো পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েক দিন আগে কয়েকটি ব্যাংককে সতর্কও করা হয়েছিল। এগুলো ব্যাংক খাত সম্পর্কে জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছে। এক্ষেত্রে দেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জনগণকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও ব্যাংক খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান ব্যতিরেকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল ব্যাংক খাত প্রত্যাশা করা যায় না। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপই এ খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে পারে। দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় ভুগছে। প্রথম সমস্যা, সুশাসনের অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা, এ খাতের জন্য প্রণীত নীতিমালা ও আইন-কানুন, কোম্পানি আইন, আন্তর্জাতিক নীতিমালা ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিপালন না করা। নিয়মণ্ডকানুন আন্তর্জাতিক মানের, কিন্তু এগুলো সঠিকভাবে অনুসৃত হচ্ছে না। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতাণ্ডঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় এ সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর বাইরে নয়। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও যে সব সময় দক্ষ হয়, তা নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রুটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়।

এসব কারণে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে, জবাবদিহির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে জবাবদিহির বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণের কথা বারবার বলছেন, তাতে সবাই আশ্বস্ত হবেন। তবে এসব উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করছে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর। এর আগেও সাবেক গভর্নর ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে সংস্কার থেকে সরে এসে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ফলে আজ ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে। এখান থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। কারণ দেশের অর্থনীতি ব্যাংক খাতের ওপর দাঁড়িয়ে। এতে কোনো ধরনের ধসের সৃষ্টি হলে তা পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে পর্যায়ে আছে, তা চিন্তাকে অতিক্রম করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পদক্ষেপ সাম্প্রতিককালে নেওয়া হয়েছে, সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে, ঋণের সুদহার হ্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো অধরাই রয়ে গেছে। অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো থেকে যাচ্ছে। কারণ, প্রকৃত কার্যকারণ চিহ্নিত করা হচ্ছে না কিন্তু ব্যাংক খাতে আস্থা আনার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে যে সক্রিয়তা প্রয়োজন, তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করার যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না। সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার এবং ঋণের হারের ওপর সুদের হারের মধ্যে পার্থক্য (স্প্রেড রেট) কমানো যাচ্ছে না।

দুঃখের বিষয়, যে ধরনের সুদৃঢ় পদক্ষেপ এবং জিরো টলারেন্স নিয়ে খেলাপি ঋণের বিষয়টিকে মোকাবিলা করা উচিত, সে ধরনের উদ্যম ও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বরং কিছু পদক্ষেপ, যেমন একই পরিবার থেকে পরিচালক নিয়োগের সংখ্যা ও মেয়াদকাল, খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের নামে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রেয়াত ইত্যাদি ব্যাংক খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার নিরিখে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ঋণখেলাপির কার্যকারণ নির্দিষ্ট করে খেলাপিদের ভাগ করা, কারা বিভিন্ন সুবিধা নিয়েও ঋণখেলাপি থেকে যাওয়াকেই ভালো ‘বিজনেস মডেল’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করা, আইনের সংস্কার ও প্রয়োগ এসব বিষয়ে কোনো উদ্যম দেখা যাচ্ছে না। এর বিপরীতে বরং বড় ও ধারাবাহিক ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন প্রণোদনা পাচ্ছেন। ফলে যারা ভালো ঋণ গ্রাহক, তাদের জন্য এক ধরনের নৈতিক বিপত্তি (মোরাল হেজার্ড) সৃষ্টি হচ্ছে। এমন প্রবণতা সুষ্ঠু আর্থিক পরিবেশ গড়ে তোলার পেছনে বড় প্রতিবন্ধক।

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, গতিশীলতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তা যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে। প্রদত্ত ঋণকে যথাযথ তদারক করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন, গাইডলাইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স এবং তদারকি বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং ব্যাংক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। অধিকন্তু অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তা ছাড়া গ্রাহককে যেনতেন প্রকারে ঋণ প্রদান করে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতেই হবে। মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ব্যাংক সেক্টরকে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি করেছে।

ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস এবং ঋণকে বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হবে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন শক্তিশালী করতে হলে বিদ্যমান আইনের সংস্কার প্রয়োজন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন- ঋণ পুনরুদ্ধার কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা। এসব উদ্যোগ তখনই সফল হবে যখন ঋণখেলাপিরা দেখবে যে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে এবং কাউকেই অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হোক। প্রস্তাবিত কমিশনের ম্যান্ডেট হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত কর খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিতকরণ; আইনি কাঠামোর সংস্কার; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান; ব্যাংক বোর্ড গঠনের জন্য নীতিমালা; আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তন। কমিশন ব্যাংক খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে। সরকারকে সেসব পরামর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close