ইসতিয়াক আহমেদ হিমেল

  ২৪ নভেম্বর, ২০২২

পরিবেশ

জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থনৈতিক বিপর্যয়

জলবায়ু হচ্ছে কোনো এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়া। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এরই ফলশ্রুতিতে নানা প্রকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, ভূমিধস, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি। বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ভূমিকম্প। ইউএনএফসিসিসির দেওয়া তথ্য মতে, বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং আগামীতে আরো ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর এতে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশ। জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল বা আপিসিসি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে জানিয়েছে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

অন্যদিকে বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুত ভূ-কম্পন এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে, ৪১ শতাংশ এলাকা মধ্যম এবং ১৬ শতাংশ এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে রয়েছে। যেখানে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬ শতাংশ উচ্চ, ৩৮ শতাংশ মধ্যম এবং ৩৬ শতাংশ নিম্ন ঝুঁকিতে ছিল। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পনজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে আছে। এসব কারণে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অবকাঠামোগত কার্যক্রম ও অর্থনীতির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অনেকটা নির্ভরশীলতাই এর মূল কারণ। এতে ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি। দেশের অর্থনীতি কৃষি থেকে উৎপাদনমুখী শিল্পের দিকে অগ্রসর হলেও অর্থনীতির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে কৃষি খাত। দেশের অর্থনীতি এখনো অনেকটাই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত কৃষি। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য মতে, এটি শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬ ভাগ জোগান দেয় এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষিক্ষেত্রে।

জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা দেশের অর্থনীতির যেসব খাতে প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার মধ্যে কৃষি খাত অন্যতম। কারণ এর উৎপাদনশীলতা পুরোপুরি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, তীব্রতা, আবহাওয়ার অবস্থা ও ঋতুবৈচিত্র্য ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রধান শিল্পগুলোর ভেতর খাদ্যজাতদ্রব্য, ধান, পাট, গম, চা, আম অন্যতম। ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল। ২০০৫-০৬ সালে যার উৎপাদন ছিল ২৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদক দেশ। ধান ও পাট এখানকার প্রধান ফসল তা সত্ত্বেও গমের বৃহত্তর গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গবেষকদের মতে, এভাবে যদি কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে তাহলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে ২ লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান ছাড়া দেশে এখন অন্যান্য শস্য যেমন- পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা প্রভৃতি। এতে মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে। তা ছাড়া রবি মৌসুমে অতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ থাকায় ফসল উৎপাদনও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিরাট অংশ মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাতও এর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাওর এবং ১১ কোটি হেক্টর চিংড়িঘেরে মাছ চাষ হয়। এ ছাড়া প্রায় ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়ে (নদী, হাওর, বিল, খাল) ২৫০ প্রজাতির মাছের বসবাস, যার মধ্যে ২৪টি প্রজাতির প্রজননও এখানেই হয়ে থাকে। এই বিপুল মৎস্যসম্পদ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে। এই বিপুল সম্পদে আঘাত লাগলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ১৮৯ মিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যা ১ দশমিক ৮১ শতাংশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সারা বিশ্বে হওয়া ক্ষতির প্রায় ২০ শতাংশই বাংলাদেশে হয়েছে। তা ছাড়া যেভাবে চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মূল আয়ের উৎসগুলো বন্ধ হতে চলেছে। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন কমে গেলে সরকার রাজস্ব এবং রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই হারিয়ে ফেলবে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি আয়ের তুলনায় ব্যয়ের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়বে।

জাতীয় পর্যায়ে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রয়োজনে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ব-দ্বীপ পরিকল্পনা একটি তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক টেকনো ইকোনমিক মহাপরিকল্পনা পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়নে ২০২৫ সাল নাগাদ জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থের প্রয়োজন হবে। নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে ও চলমান দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বিদ্যমান অবকাঠামোগত স্থাপনায় আনতে হয় নকশাগত ও আবকাঠামোগত পরিবর্তন। যেমন- লোনা পানি ঠেকাতে দেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর নকশা পাল্টে মেরামত ও নতুন পোল্ডার তৈরি করা এবং নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ও আচরণগত পরিবর্তনে সেচ প্রকল্পের সংস্কার সাধন। তা ছাড়া উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণে প্রতি বছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। দাতা সংস্থাগুলো এই ব্যয় বহন করতে অস্বীকৃত হলে বাংলাদেশ সরকারকে অভ্যন্তরীণ আয় থেকেই এসব ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থঘাটতি দেখা দেয়। ফলে সরকারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।

আইএমএফ সূত্র মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশ এবং ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়াও উপকূলীয় কম্বোডিয়া, চীন, মিসর, গায়ানা, সুরিনাম, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের অর্থনীতিও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেইসঙ্গে তাপমাত্রা আরো বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট কৃষি, বনজ, উপকূলীয় আবাসন ব্যবস্থা এবং পর্যটন খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া আগামী কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসার ঝুঁকির কবলে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় অর্ধেক অঞ্চল। অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক দিয়ে মালদ্বীপ ও নেপাল সবচেয়ে ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। দেশ দুটির চলতি শতাব্দী শেষে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষতি ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা নেপালের প্রায় কাছাকাছি।

২৬ মে ২০২২, বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান-২১০০ আন্তর্জাতিক কনফারেন্স : বাস্তবায়নে সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা শীর্ষক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো মতেই দায়ী নয়’।

আমাদের উচিত আগামী শতাব্দীতে অর্থনীতির চাকাকে সচল ও পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পৃথিবীর সব মানুষ ধনী-দরিদ্র, উত্তর-দক্ষিণ ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে আসা। একই সঙ্গে রিওডি জেনেরিওর ‘ধরিত্রী সম্মেলন’ ১৯৯২, ‘কিয়োটা প্রটোকল’ ১৯৯৭, ‘বিশ্ব টেকসই সম্মেলন’ ২০০২, ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ ২০১৫, সহ বিশ্বব্যাপী সব পরিবেশ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সবাই জাতিসংঘের পতাকাতলে সমবেত হই।

লেখক : শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও বহু মাধ্যম সাংবাদিকতা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close