রফিকুল ইসলাম

  ২৩ নভেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

শিক্ষাব্যবস্থায় বহু ধারা সমস্যা ও সমাধান

বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। মৌলিকভাবে দেশে সাধারণ, মাদরাসা, কারিগরি ও ইংরেজি মাধ্যম প্রভৃতি স্বীকৃত ধারার শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও এর বাইরে আরো কিছু উপধারা লক্ষ করা যায়। যেমন খোদ মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাতেই আলিয়া ও কওমি নামে দুটি ধারা বিদ্যমান। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের বিভক্তি নানামুখী জটিলতা সৃষ্টি করছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এত ধরনের রকমফের থাকায় দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সব শিক্ষার্থীর সমমান ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে বিভিন্ন ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অসামঞ্জস্যতা থেকে যাচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক কাঠামোর ওপর।

দেশে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি থাকলেও একে মোটাদাগে সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা, এ দুটি ধারায় ভাগ করা যেতে পারে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে মাদরাসা ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের সুযোগ তৈরি হলেও বিজ্ঞান শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে আছে মাদরাসাগুলো। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষা তথা স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে বাংলা, গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও ধর্মীয় বিষয়গুলো যেমন কোরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির ইত্যাদি বিষয় একেবারেই উপেক্ষিত। নামমাত্র ইসলাম শিক্ষা বিষয় থাকলেও তা ইসলামের মৌলিক ধারণা লাভ করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে যারা স্কুল-কলেজে পড়ছে স্বভাবতই ধর্মীয় বিষয়ে তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জ্ঞানার্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসার পাঠ্যসূচি কার্যত এর বিপরীত। কোরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসিরকে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সাধারণ বিষয়াবলির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বাংলা, গণিত, ইংরেজির মতো কিছু বিষয় পড়ানো হলেও তা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। এতে তারা দেশের অন্যান্য ধারায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকছে। আবার সরকারি আলিয়া মাদরাসাগুলো এতদুভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করলেও এখানেও রয়েছে বহুমুখী সংকট। আরবি, কোরআন, হাদিস পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকলেও মাদরাসাগুলোতে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, আইসিটি বিষয়ের সুযোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে স্বভাবতই অধিকাংশ সময় স্কুল-কলেজ ছাত্রদের থেকে পিছিয়ে থাকে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা।

পাঠ্যসূচির এ ভিন্নতার কারণে স্বভাবতই একেক ধারার শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা একেকরকমভাবে গড়ে উঠছে। কখনো কখনো এদের কোনো পক্ষ নিজেদের ধর্মের রক্ষাকর্তা, আবার কোনো পক্ষ নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঠিকাদার দাবি করে তর্কে জড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়!

একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে সব নাগরিকের জন্য গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। তাই এ সব সংকট সমাধানে রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় মূলত এক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার প্রাক্কালে মুসলিম শাসিত ভারত ও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তদারক করার জন্য যথাক্রমে ড. লিটনার ও মি. এডামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মি. এডাম বাংলাদেশ সম্পর্কে এই রিপোর্ট পেশ করেন যে, তদানীন্তন বাংলায় এক লাখ স্কুল ছিল। প্রসংগত জেনারেল সিøমেন এ সময়কার শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ‘রেমবলস অ্যান্ড রিক্যালেকশন’ গ্রন্থে যে তথ্য পরিবেশন করেন তা সংক্ষেপে- ক. প্রাথমিক স্তর :

১. ধর্মীয় শিক্ষা ২. পঠন ৩. লিখন ৪. গণিত।

খ. উচ্চতর স্তর :

১. আরবি ২. ফারসি ৩. ব্যাকরণ. ৪. অলংকার শাস্ত্র ৫. দর্শন ৬. আখলাক ৭. বিজ্ঞান ৮. শিল্পকলা ৯. গণিত ১০. ধর্মতত্ত্ব ১১. ইতিহাস।

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত UNESCO-Gi Studies on Compulsory Education-এ বিবৃত হয়েছে যে, ‘মুসলিম শাসনকালে শিক্ষা ও ধর্মকে অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে বিবেচনা করা হতো। ইসলামে পুরোহিততন্ত্রের কোনো স্থান নেই এবং বর্তমান জীবনের জন্য প্রস্তুতি হিসেবেই শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হতো’। Jams K. Haider তার ‘India: Impression and Suggestions’ গ্রন্থের ৫নং পৃষ্ঠায় বলেন, তৎকালীন বাংলাদেশে (যার অধিকাংশ বর্তমান বাংলাদেশে) ৮০,০০০ বিদ্যালয় ছিল। অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রতি ৪০০ জনের একটি স্থানীয় বিদ্যালয় ছিল। William Adam নামে এক মিশনারি শিক্ষাবিদ ১৮৩৫-৩৮ খ্রিস্টাব্দের সময়টুকুতে এক জরিপ পরিচালনা করে দেখান, তৎকালীন দেশে এক লাখ বিদ্যালয় চালু ছিল। ব্রিটিশ-পূর্ব সময় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিরূপ ছিল তা ওই দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই আঁচ করা যায়। তৎকালীন সময়ে এ ধারা থেকে গড়ে ওঠাদের মধ্য থেকেই প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হতো। ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষার আলাদা আলাদা ধারা ছিল না বলেই অনুমিত হয় সে সময়ের শিক্ষাব্যবস্থায়।

ইউনেস্কোর ঘোষণা এবং গিনেস ওয়ার্ল্ডের রেকর্ডস অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় যা ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ফাতেমা আল-ফিহরী। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই ছিল একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। এ বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগের মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখে। শুধু মুসলমান না, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি এবং খ্রিস্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার, যিনি এখান থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করে সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দের প্রথম শূন্যের (০) ধারণার সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। ইহুদি চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিক মায়মোনাইডসও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম একজন ছাত্র ছিলেন। এখানে এক ছাদের নিচে ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় বিষয়ই সমান গুরুত্বের সঙ্গে শেখানো হতো। নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় বিষয়ই সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। উচ্চতর পর্যায়ে প্রত্যেকে নিজেদের পছন্দের বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারত। ফলে দেখা গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি ধর্মীয় বিষয়েও ছিল তাদের অগাধ পা-িত্য। তাদের মধ্য থেকে একদিকে যেমন বের হয়েছেন ইবনে রুশদের মতো দার্শনিক, তেমনি বের হয়েছেন আল-ইদ্রিসির মতো ইতিহাসবিদ, অন্যদিকে কাজি ইয়াজ এবং ইবনে আরাবির মতো আলেম এবং সুফি বের হয়েছেন। সেখান থেকেই বের হয়েছেন ইবনে খালদুনের মতো সমাজবিজ্ঞানী। আলেম বলেন আর বিজ্ঞানী বলেন সবার পোশাক-আশাক, চাল-চলন, মন-মানস একইভাবে গড়ে উঠত। ফলে তাদের মাঝে কোনো সংকীর্ণতা থাকত না, থাকত না পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ। কারণ তাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মৌলিক বিষয়গুলো জানত এবং একই প্রতিষ্ঠানে পাশাপাশি সহাবস্থানের কারণে তাদের মাঝে গড়ে উঠতো পরস্পর সৌহার্দ ও বন্ধুত্ব। বর্তমানেও যদি আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট একটি স্তর এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্ত একই পাঠ্যসূচির আওতায় নিয়ে আসতে পারি তাহলে প্রত্যেক বিষয়ের মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যেকেই জানত, ফলে দূরত্ব কমে আসত, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ কমে যেত। পরবর্তী সময়ে যে যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চাই সে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারত। তাই আমরা বলতে চাই, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের ধাঁচে দেশের তারুণ্যকে গড়ে তুলতে এখনো প্রয়োজন সমন্বিত ধারার শিক্ষাব্যবস্থা, যা একই সঙ্গে ব্যক্তির আত্মিক ও জাগতিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close