ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমা বেগম নাজু

  ২৩ নভেম্বর, ২০২২

মুক্তিযুদ্ধ

আমাদের সংগ্রামী চেতনার অস্তিত্বময় স্বাক্ষর

বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী অনুষদের মধ্য দিয়ে। মহান এ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত পথ ধরে যেমন অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা, তেমনি গর্বিত চেতনায় স্বাক্ষরিত হয়েছে- বীরত্ব, সাহস, মনোবল, আদর্শ, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, জাতীয় চেতনা ও ঐক্যবোধ। এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি এক চিরস্মরণীয় অনুপ্রেরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিশ্বের ইতিহাসে। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করেছে স্বাধীনতাকামী সব মানুষের হৃদয় প্রাঙ্গণ। অনেক কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অর্ধশতকেরও বেশি পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি। স্বাধীনতার আদর্শ, মূল্যবোধ এবং চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটাও তাই এখনই মেলাতে হবে। কঠিনতম এ হিসাবের দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে।

পৃথিবীকে সংগ্রামী সম্ভাবনার স্বপ্নটা আমরাই দেখিয়েছি। সামনে এগিয়ে যাওয়ার আলোময় পথটাও আমাদের দেখাতে হবে। সুদীর্ঘ সংগ্রামী সাধনার যা ছিল আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ, যাকে সামনে রেখে আমরা কঠোর আন্দোলনে নেমেছি, রক্তের সাগরে ভেসেছি, অকাতরে আত্মোৎসর্গ করেছি, লাখ লাখ নারী জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বস্ব ধুলায় মিশিয়েছি জাতীয় চেতনা ও ঐক্যবোধকে একাত্ম রাখতে হবে অভীষ্ট সে লক্ষ্যে। অমর ভাষা আন্দোলনের সূর্য দীপ্ত অঙ্গীকার হতে শুরু করে একাত্তরের অগ্নিমশালের প্রতি নিশ্বাসের গভীরে একাকার হয়ে মিশে আছে সে লক্ষ্য ও আদর্শের স্বাক্ষর। আপন বুকের পবিত্র রক্তের দামে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বপ্ন ও আদর্শের পরমাকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও মাতৃভূমি। যে সংগ্রামী চেতনা ও মূল্যবোধের আদর্শে স্বাক্ষরিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তা হলো- দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্য।

ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যাশা নিয়ে। অল্প কিছুদিনের মাঝেই ভেঙেচুরে ছারখার হয়েছিল সে স্বপ্নের বেড়াজাল। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো এমনই ছিল যে, শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানরা অপরিসীম বঞ্চনার শিকার হয়। বহু বছরের জমে থাকা ক্ষোভ পুনরায় নতুন করে দানা বাঁধতে শুরু করে তখনই। আপন অস্তিত্বের প্রতি অবিচল বাঙালির এ প্রতিবাদ শতগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। এ আন্দোলন একাত্ম ও অভিন্ন করে আপামর বাঙালি এবং বাঙালি সত্তাকে। বায়ান্ন থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত সে আন্দোলনের তীব্র শক্তিতে কেঁপে উঠল প্রতি বাঙালির হৃদয়, তীব্রতম হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব বাংলার প্রতি অনুকণায়। সে আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল আপামর জনসাধারণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার দাবি। সে আন্দোলন জোরালো ও ঘনীভূত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিল। পুঞ্জীভূত বঞ্চনার আগুনকে প্রজ্বলিত মুক্তির মশাল বানিয়ে প্রতিটি বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।

দেশভাগের সামান্য কিছু পরেই পরিপূর্ণ রূপে বিকাশ ঘটেছিল ‘বাঙালি’ শব্দটির। এর আগে বিভিন্ন কারণে এ শব্দটির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের তেমন যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ে জাতিসত্তার সেই একাত্ম অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা পেল। কিন্তু স্বাধীন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার কারণে এ ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ হলো না। সাম্প্রদায়িকতা আর হানাহানির রেশ থেকে মুক্তি পেল না স্বাধীন বাংলাদেশ। এর প্রকাশ ঘটল বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায়। অথচ গণতান্ত্রিক এক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই আমরা সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের সেই সংগ্রামী চেতনার অস্তিত্বময় স্বাক্ষর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও পূর্ব বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল পশ্চিমা শাসক চক্র। সেই ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করে নিতে প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির বুকে রক্তের বন্যা বয়ে গেল। দীর্ঘ সময় রক্তের নদীতে সাঁতরাতে হলো আমাদের। জাতিসত্তার অস্তিত্বময় প্রজ্ঞায় আমাদের বিজয় এসেছিল। জয় হয়েছিল জাতীয় চৈতন্যে একাত্ম মানবতার। উপমহাদেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। কিন্তু জাতীয় চেতনাবোধে উদ্ভাসিত বাঙালি জাতি ধর্মীয় ধারণাকে আরো বেশি বিস্তারিত করেছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে। ১৯৬০ সালের ব্যাপক আন্দোলন আমাদের এ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরো বেশি সার্বজনীন করে প্রতিষ্ঠিত করল। পাকিস্তানের আদর্শ ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভিন্ন মতাদর্শীর মানুষ হত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল তারা।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যগুলো আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেই। দমন এবং শোষণ নীতির নিষ্পেষণে বিপর্যস্ত হলো পূর্ব বাংলা। বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটল বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং এর ছয় দফায়। ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে এ বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন আরো ঘনীভূত রূপ ধারণ করে।

অধিকার আদায়ের এ লক্ষ্যভেদী আন্দোলন গড়িয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। এ লড়াই ছিল মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য, স্বাধীন মতামত ও সত্য কথা বলার অধিকারের জন্য, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য, মানবাধিকারের জন্য, সুস্থ রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য। সমষ্ঠিগতভাবে যা বাঙালির জাতীয় সত্তার পূর্ণাঙ্গ চর্চা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যময় অস্তিত্বেরই জ্বলন্ত প্রতিফলন। অনেক বছর ধরে বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাঝ দিয়ে আমরা অর্জন করেছি অনন্য নৈতিক ভিত্তি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের শপথনামা।

মহাকালের প্রতিটি ইতিহাসেই রয়েছে টিকে থাকার লড়াই। কখনো কখনো যুদ্ধ বেঁচে থাকার সাহসী চিৎকার হয়ে আসে। শত বছরের সাহসী প্রত্যয় ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সংগ্রামী অস্তিত্বের জ্বলমান স্বাক্ষর। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান শুরু থেকেই আমাদের ঘোর বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধে এর হিংস্রতম প্রকাশ ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চরমভাবে পদদলিত হয় মানবতা। যুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ বিভিন্ন অপকর্মে উন্মত্ত হয়েছিল তারা। এ যুদ্ধে তাদের চরম নৈতিক অবক্ষয়ের বিপরীতে আমাদের অবস্থান ছিল মানবতা ও আদর্শের ধারায় উদ্ভাসিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের পবিত্র শাখায় প্রজ্বলিত। এই আদর্শ এবং চেতনাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। বিজয় আমাদেরই হয়েছিল। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার এবং মানবতার এ অস্তিত্বময় শপথই ত্বরান্বিত করেছে আমাদের মুক্তি এবং স্বাধীনতা।

সম্মানে, মর্যাদার, গৌরবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমরাই। বিবেক বর্জিত মর্যাদাহীন জাতি হিসেবে ধিক্কৃত হয়েছে তারাই। আমাদের নামীয় উচ্চারণে যখন বিশ্বমানবতা জয়গানে মুখর হয়, তখন তাদের জন্য দলা পাকিয়ে ওঠে কেবলই ঘৃণা। আমাদের অস্তিত্বময় আয়োজনের এ মুক্তি সংগ্রাম হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। সবার হৃদয়ে অভিন্ন সুরে দোলায়িত হয়েছে ঘুমভাঙানিয়া সে সুরের ঐকতান। অরুণোদয়ের সেই নতুন ভোরের সুরভি পৃথিবীতে ছড়িয়েছি আমরাই।

লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক ও চিকিৎসক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close