আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২২ নভেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

প্লাস্টিকজাত পণ্যের হুমকিতে পরিবেশ

মানুষের স্বাস্থ্য, গড় আয়ুসহ অনেক কিছুই নির্ভর করে দেশের পরিবেশের ওপর। বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা পরিবেশ বিপর্যয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন শপিং ব্যাগ ও প্লাস্টিক পানির বোতল, স্ট্র, কাপ, প্লেট, চামচ, খাবার বাক্স ইত্যাদির ব্যবহার। তাই এক কঠিন সময়ের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এজন্য বর্তমানে দেশে পরিবেশের যে অবস্থা তা শুধু চিন্তিত হওয়ারই নয়, উদ্বিগ্নের বিষয়ও। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৮ শতাংশ মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত বিভিন্ন অসুখণ্ডবিসুখে। পরিবেশ দূষণের কারণে শুধু ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, মানুষের তৈরি ময়লা-আবর্জনাও তেমনি বাড়ছে।

কিছুদিন আগেও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে আমরা পাট বা কাপড়ের ব্যাগ এবং অনেকেই বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে হাঁট-বাজার করতে যেতাম। কিন্তু বাংলাদেশে ৮০-এর দশকের পর হতে ধীরে ধীরে এসব প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি পাত্র দৃশ্যপট হতে প্রস্থান শুরু করে। বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের ঘরের চারপাশে লক্ষ করলে দেখা যায়- খাদ্য পরিবহন, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে খাদ্য পরিবেশনের পুরোটাই পলিথিন ব্যাগসহ প্লাস্টিকজাত পণ্যের আধিপত্য। এর মধ্যে এসেছে মহামারি করোনাভাইরাস, ধ্বংস করতে চাচ্ছে মানবসভ্যতা এবং রেখে যাচ্ছে ক্ষতের চিহ্ন।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে প্লাস্টিক ও পলিথিন শপিং ব্যাগ (থলের) ব্যবহার, উৎপাদন ও পরিবহন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে ১৭টি পণ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহন পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারপরও করোনা মহামারির সময়ে সুরক্ষার নামে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত পণ্য ও পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো দেখা বা মনিটরিংয়ের যেন কেউ নেই। ২০১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হতে আরো জানা যায়, ঢাকা শহরে বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এসব প্লাস্টিক ব্যবহারের পর যেখানে সেখানে ফেলা হয়, এতে মিঠা পানি ও সামুদ্রিক জীবের জীবন বিপন্ন হয়। বাংলাদেশে বছরে প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। যার মধ্যে দুই লাখ টন বর্জ্য নদী-নালার মাধ্যমে সমুদ্রে পতিত হচ্ছে, অনেক সামুদ্রিক প্রাণী এসব প্লাস্টিকজাত দ্রব্য খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরে দিনে ৩০০ ধরনের ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিকজাত পণ্য পতিত হচ্ছে। এসব প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের কারণে সমুদ্রে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে সামদ্রিক জলজ প্রাণী এখন হুমকির সম্মুখীন।

অতি সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২১ সালের বর্জ্যবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরের বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৭৮৫ টন বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে বেশি থাকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক ও পলিথিন। আবর্জনার কারণে পানিদূষণের পাশাপাশি নদীর গভীরতাও কমে আসছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় ওঠে এসেছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ও বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের অন্য আরেকটি গবেষণা প্রবন্ধে তথ্য ওঠে এসেছে, প্রতিদিন চট্টগ্রাম মহানগরীর ৮৭ লাখ মানুষ ৩০০ টন বর্জ্য সৃষ্টি করে যার মধ্যে ২৪৯ টনই প্লাস্টিক বর্জ্য। যার ৫৬ শতাংশ (১৪০ টন) রিসাইক্লিংয়ের জন্য সংগ্রহ না করায় নগরীর খাল-নালা পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে মিশে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে পরিবেশ।

বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে দেশের নগরগুলোতে এর ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। শহরাঞ্চলে পরিবেশ অবক্ষয়ে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬৫০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিবেশ দূষণে বড় অনুষঙ্গ এখন প্লাস্টিকের অতিমাত্রার ব্যবহার। রাজধানীতে বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এই প্লাস্টিকের প্রায় অর্ধেক মাটি ও পানিতে রয়ে যায় এবং মারাত্মক দূষণ তৈরি করছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের বর্জ্যরে কারণে রাস্তায় পাশে জমা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা, নদণ্ডনদী, খাল-বিল ও নালায় গিয়ে বাড়াচ্ছে জলাবদ্ধতা। পাশাপাশি বাড়ছে পানিদূষণ, দুর্গন্ধযুক্ত আবহাওয়া। যা জনস্বাস্থ্যকে ফেলছে হুমকিতে। প্লাস্টিক পলিথিন বর্জ্য নদী ও সাগরের তলদেশে জমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এই পলিথিন প্লাস্টিক বৃহৎ জলজ প্রাণী তিমিরও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালে ঢাকার বাইরে অন্যান্য নগরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, ২০২০ সালে হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে ব্যক্তির মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯ কেজি থেকে বেড়ে প্রায় ২৩ কেজি হয়েছে। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে, আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মিশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া।

রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেকোনো প্রচলিত আইন যদি যথাযথ প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে উক্ত আইনের কার্যকরিতা থাকে না এবং আইনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। একইভাবে বিকল্প চটের ও কাপড়ের ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও বাজারে পলিথিন ব্যাগের দৌরাত্ম্য বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

আর্থ ডে নেটওয়ার্কের তথ্য মতে, বাংলাদেশ ১০ প্লাস্টিক ব্যবহারকারী দেশ। এক কেজি প্লাস্টিক ও পলিথিন উৎপাদন করতে বায়ুমণ্ডলে মিশে দুই থেকে তিন কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। যদিও উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। এই কার্বন গ্যাস নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলীর ওজোনস্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ার, আইনোস্ফিয়ার, যা সূর্যের ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট-রে (অতি বেগুনি রশ্মি)-কে পৃথিবীতে সরাসরি আসতে বাধা দিত। তবে তা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পৃথিবীতে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। ওজোন স্তরের ক্ষতি ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর ওপর বিশাল প্রভাব পড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে হিমালয়, এন্টারর্কটিকার বরফ আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে গলছে, এর ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্ষতিসহ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে।

প্রবাদ আছে, ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। অনেক আগে থেকেই আমরা পরিবেশকে ইট মেরে এসেছি। নিজেদের ইচ্ছামতো ধ্বংস করেছি পরিবেশের উপাদান। প্লাস্টিক দূষণ হলে যা পরবর্তী সময়ে পরিবেশে বিশেষ করে বন্যপ্রাণ, বন্যপ্রাণ আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। এমনিতে বর্ষাকাল ঢাকা শহরের রাস্তা ও সড়কগুলো জলাবদ্ধতার কারণে পানির নিচে চলে যায়। কারণ প্লাস্টিকজাত পণ্য ও পলিথিন ব্যাগ ব্যহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার ফলে নগরের নালা-নর্দমা ও সুয়ারেজ লাইনে আটকা পড়ে। ফলে যথা সময়ে বৃষ্টির পানি ও সুয়ারেজ লাইনের পানি অপসারণ হতে না পেরে রাস্তা ও সড়কে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

পৃথিবীর সর্বত্র প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ছড়িয়ে আছে। আমাদের দেশেও একই চিত্র। প্লাস্টিকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু অসম্ভব নয়। এই পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে, বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি, নদী-নালা, সভ্যতা, সংস্কৃতি সবই হারিয়ে যাবে সমুদ্রের অতল গভীরে। এই মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কেবলমাত্র সামাজিকভাবে সচেতন হলে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর-সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব।

লেখক : আইনজীবী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close