সৈয়দ মো. জাহেদুল ইসলাম

  ০৮ অক্টোবর, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দোদুল্যমান জনস্বাস্থ্য

পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর একটি প্রসঙ্গের নাম জনস্বাস্থ্য, যার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দ্বারা। গত এক শ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় এক ডিগ্রি, যা বিগত এক হাজার বছরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তাপমাত্রার দ্বিগুণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রভাব সরাসরি প্রকৃতি ও মানুষের ওপর পড়ছে। অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস, খরা, সাইক্লোন ইত্যাদি এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জলবায়ুর এমন পরিবর্তন সরাসরি প্রভাবিত করছে জনস্বাস্থ্যকে, যার চরম পরিণতি ভোগ করছে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। আইপিসিসির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বিশ শতক জুড়ে বড় আকারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়। জাতিসংঘের প্রতিবেশ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থার তথ্যমতে এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবীতে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব শরণার্থী নিজ বাসভূমি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র, যেখানে তাদের অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার কোনো নিরাপত্তা নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূলত সামাজিক ও প্রতিবেশগত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। সুপেয় পানি, বিশুদ্ধ বাতাস, পর্যাপ্ত খাদ্য, নিরাপদ বাসস্থানের ওপর সৃষ্ট প্রতিবেশগত প্রভাব জনজীবনে চরম বিপর্যয় নিয়ে আসে। জলবায়ুবিষয়ক বিবিধ সংস্থার প্রদত্ত তথ্য মতে ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হবে অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ ও তাপজনিত চাপের কারণে। জলবায়ুর পরিবর্তন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, যেখানে অপর্যাপ্ত খাদ্য, পুষ্টিহীনতা, অনিরাপত্তা উল্লেখযোগ্য। এসব অনুঘটকের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে অভিগমন শুরু করে উন্নত জীবনব্যবস্থার সন্ধানে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সীমানায় এই অভিগমন যেটুকু নিরাপদ, তা অনেক বেশি ভয়াবহ হয় অন্য কোনো দেশে অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে। প্রায়ই শোনা যায় নিজ দেশে সর্বস্ব হারিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক কিংবা নিহত হন। এ ক্ষেত্রে জলবায়ুগত সংকট অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিপরীতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বায়ুমণ্ডলে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস, যার ফলে তাপমাত্রা অনেকাংশে বেড়ে যায়। মানুষের বেঁচে থাকা এবং প্রকৃতির টিকে থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রয়োজন রয়েছে, অন্যতায় পৃথিবীর তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে তা প্রাণিকুলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তবে বনাঞ্চল ধ্বংস, অতিরিক্ত শিল্পায়ন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও নানান কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, জনজীবন হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ। অতিবৃষ্টি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনিরাপদ খাদ্য ও পানীয়, দরিদ্রতা এবং দুর্ভিক্ষের ফলে মানবজীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এসব বিষয়ের নেতিবাচকতা সরাসরি ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে বলে ধারণা করা হয়।

দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে, যেখানে অনিরাপদ খাদ্য ও দূষিত পানীয় সাধারণ একটি বিষয়। পরিবেশ দূষণের ফলে নতুনতর রোগের বিস্তার হয়, মহামারি বিরূপ আকার ধারণ করে এবং জনস্বাস্থ্য পর্যুদস্ত হয়ে যায়। পরিবেশ দূষণ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে দায়ী অনুঘটকসমূহ হলো শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বাস্তুতন্ত্রের অনুপযোগী পণ্য, বনাঞ্চল ধ্বংস, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবহেলা, পরমাণু শক্তিকেন্দ্র স্থাপন, অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবহার ইত্যাদি। তাপমাত্রার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি, নিরাপদ পানির অভাব, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বর্তমানে অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়। এসব অস্বাভাবিকতা কিংবা বিপর্যয় জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে প্রতিনিয়ত। এর সমাধানে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিরা নানান সভার আয়োজন করলেও অদ্যাবধি টেকসই কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে এর থেকে পরিত্রাণের আশা দেখা দিলেও নতুন কোনো বাধা এসে সেই সম্ভাবনাকে গ্রাস করে ফেলে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন। অথচ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে দেখা যায় এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুরোপুরি প্রাচ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। উন্নত দেশগুলো প্রাচ্যকে শোষণ করে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাচ্যের জনগোষ্ঠী এবং তার পরিবেশ চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে বর্তমানে জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মহামারি নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য নীতিতে ব্যাপকভাবে জোড় দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের সংরক্ষণে এখনই সময় নতুনভাবে ভেবে দেখার। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করে তা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমরা এরই মধ্যে দেখতে পায় আমাদের চতুর্দিকে ঘটমান বিষয়াবলি থেকে। সুতরাং এর সমাধানে এখনই ঊর্ধ্বতন মহলের সচেতন হওয়া উচিত।

জনস্বাস্থ্যকে সামাজিক, মানসিক, প্রতিবেশিক ইত্যাদি প্রসঙ্গের বিবেচনায় আলোচনা করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বৃহৎ পরিসরে নীতিমালা তৈরি করে তা ক্ষুদ্রপর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে। নবায়ন অযোগ্য শক্তির সংরক্ষণ, বনাঞ্চল ধ্বংস না করে বনায়ন চর্চায় উদ্বুদ্ধকরণ, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বস্তুর প্রয়োগ, সুপেয় পানির মজুদ, নিরাপদ বাসস্থান তৈরি ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে আমরা জলবায়ুর মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন করতে পারি। এর মাধ্যমে রোগের প্রকোপ হ্রাস পাবে, তাপমাত্রা স্থিতিশীল হবে, নিরাপদ খাদ্য ও পানীয়ের অভাব দূর হবে এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমস্যা বৈশ্বিক হলেও সমাধান হতে হবে আঞ্চলিক, অর্থাৎ ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন দ্বারা জাতীয় তথা বৈশ্বিক সংকট সমাধান করতে হবে। পরিবর্তনের বহমান ধারায় এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক কল্যাণে আমরা এক হয়ে কাজ করে যাব। কারণ এই ভূখণ্ডের সুরক্ষার দায়িত্ব যেটুকু আমার, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের।

লেখক : গবেষণা সহকারী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close