মো. মমিনুর রহমান
বিশ্লেষণ
ইকোনমিক মিরাকেল রাজনীতি একটি অনুঘটক
যেকোনো দেশের বা ব্যক্তির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে অর্থনীতি। এই অর্থনীতির অবস্থা যে দেশের যত ভালো, সে দেশ তত উন্নত। প্রত্যেকটি দেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পলিসি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। কেননা অর্থনীতি আমাদের জাতীয় জীবনের নিরাপত্তার ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে। একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও কর্মঠ জনবল এবং সেই সঙ্গে সরকার তথা নিজ দলের রাজনৈতিক নেতাদের পবিত্র মনোভাব।
বিল ওয়েন্সের মতে, একটি শক্তিশালী অর্থনীতি, সুশিক্ষিত কর্মীদের দিয়ে শুরু হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। আর এর আশু দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের। সরকার ছাড়া যেমন একটি রাষ্ট্র হতে পারে না, তেমনি সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনাবিহীন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মিরাকেল সম্ভব নয়। আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মিরাকেল একই রকম মনে করি। প্রকৃতপক্ষে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি জাতি, অঞ্চল, স্থানীয় সম্প্রদায় বা কোনো ব্যক্তির অর্থনৈতিক কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে উন্নত করা। Sharma -এর মতে, অর্থনৈতিক মিরাকেল হচ্ছে একটি সময়কাল, যা প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুত। একটি দেশের অর্থনৈতিক মিরাকেল, দেশের জিডিপি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অনেকাংশে আকাশচুম্বী করে তোলে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অর্থনৈতিক মিরাকেল হওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না, বরং দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতানুগতিক ধারার মধ্যে চলতে হয়।
একটি পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেমন স্বামী ও স্ত্রীর সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রয়োজন, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক মিরাকেলের জন্য সামগ্রিক অর্থনীতির উপাদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক ফ্যাক্টর অপরিহার্য। তাহলে কি দেশের অর্থনৈতিক মিরাকেল সামষ্টিক অর্থনীতির উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর না করে, রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো পরিবারের রমণীর ভূমিকা পালন করে ? অবশ্যই অর্থনৈতিক মিরাকেলে রাজনৈতিক ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোতে দেখা যায় কীভাবে তারা অর্থনীতিতে এতটা উন্নত।
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রভাবিত হয় সামগ্রিক অর্থনীতির কতগুলো উপাদানের মাধ্যমে যেমন শ্রমিক, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থান, সুদের হার, বিনিয়ম হার, বিদেশি বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য। সামগ্রিক অর্থনীতির উপাদানগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো দেশের অর্থনৈতিক মিরাকেলে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক ফ্যাক্টর বলতে সরকারের নেতৃত্বের গুণাবলি, পলিটিক্যাল উইল, সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচি (PPP) বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে কাজ করানো ইত্যাদি। Transparency International (TI) -এর মতে political will হচ্ছে এমন এক ধরনের প্রতিশ্রুতি যা রাজনৈতিক নেতারা দিয়ে থাকেন এবং আমলারা সেসব লক্ষ্য পূরণে কাজ করে থাকেন।
১৯৭৮ সালে চীন ও ভারতের জিডিপি (GDP) একই থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতের চেয়ে অনেক উন্নত এবং সেটা ৫ গুণ। সে সময় চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত বিভিন্ন পলিসি গ্রহণ করে এবং বাস্তবায়ন করে, অন্যদিকে ভারত ধনতান্ত্রিক নাকি সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করবে এই সিদ্ধান্ত নিতে ১৫ বছর কেটে যায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকায় চীন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেও ভারত ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে, বর্তমানে চীন ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান আর সেটা সম্ভব হয়েছে পলিটিক্যাল উইলের নিমিত্তে।
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ইতিবাচক থাকলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বৈদেশিক চুক্তিবদ্ধ হওয়া সহজ হয়। ফলে দেশগুলোর মধ্যে আমদানি ও রপ্তানির পথ মসৃণ হয় এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু বৈদেশিক চুক্তি প্রসারিত করে থেমে থাকে না বরং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ করতেও সাহায্য করে। রাজনৈতিক অবস্থা ভালো থাকার দরুন বিভিন্ন দেশ কিংবা দাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি ঋণ দিতে আগ্রহ পোষণ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়েছিল, বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে সম্মতি জানায়। কিন্তু পরে রাজনৈতিক ইস্যু কিংবা দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অন্যান্য দাতা সংস্থাও অর্থ দিতে অস্বীকার করে। পরিণতি হিসেবে ১২ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু ৩০ হাজার কোটিরও বেশি অর্থ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তবু বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে যে দুঃসাহসিক পরিচয় দিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার বয়স প্রায় ৭৫ বছর হলেও কোনো সরকার ৫ বছর তার শাসনকার্য চালিয়ে যেতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা অস্থিতিশীলতার দরুন তাদের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানেরও ৫ বছর যেতে না যেতেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে বিদেশি অনেক দাতা সংস্থা ঋণ দিতে আগ্রহী না। তেলের অভাবে দেশের অনেক ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেদের সম্পদ অন্য দেশের কাছে জিম্মি রেখে চলতে হচ্ছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি ধসের একটি কারণ রাজনৈতিক ফ্যাক্টর। ঠিক তেমনি, রাজাপাকসের সঠিক নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার অভাবে শ্রীলঙ্কার নাজেহাল অবস্থা।
রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোর কারণে পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিঙ্গাপুর আয়তনে ছোট্ট হলেও অর্থনীতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উন্নত। গত শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বব্যাংক (World Bank) ১৯৯৩ সালে পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ে জরিপ করে দেখেছে দেশগুলো কিনেসিয়ানের অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসরণ করছে। কিনেসিয়ানের তত্ত্ব বলতে সরকার ব্যক্তিগত প্রজেক্টগুলো দেখভাল করবে এবং প্রয়োজনে অর্থ বিনিয়োগ করে সাহায্য করবে। দেশের একজন নাগরিক কোনো প্রজেক্ট হাতে নিলে সরকার অর্থ বিনিয়োগ করে অথবা প্রশাসনিক সহযোগিতা করছে। ফলে, সহজেই দেশগুলোতে প্রজেক্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আকারের পরিবর্তন হচ্ছে এবং ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কিনেসিয়ানের অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসরণ করলেও সেটা খাতাণ্ডকলমে আছে বাস্তবে তেমন একটা নেই। একজন ব্যক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নে কিংবা কর্মসংস্থান তৈরিতে মনোনিবেশ করে যখন একটি প্রকল্প হাতে নেয়, সরকারের দায়িত্ব অর্থ বিনিয়োগ কিংবা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা। এমনকি সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় ছোটখাটো শিল্প কিংবা প্রজেক্টগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক দশক আগেও চামড়াশিল্প দেশের অন্যতম খাত হিসেবে পরিচিত ছিল কিন্তু আজ এই শিল্পের খাতের বেহাল দুর্দশা। গত কোরবানির ঈদে পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নদী বা পুকুরে চামড়া ফেলে দিয়েছে। সরকার যদি বিষয়টি সুনজরে দেখত তাহলে চামড়াশিল্পের মতো অন্যতম একটি শিল্পের অবস্থা মুমূর্ষু হতো না। তবুও বাংলাদেশ গত এক দশকে অর্থনীতির বিকাশ এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেছে। গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বিনিয়োগ লক্ষাধিক শ্রমিকদের চাকরির ব্যবস্থা করেছে, যাদের বেশির ভাগই নারী। পোশাক এবং সংশ্লিষ্ট পণ্যের রপ্তানির ৪০ শতাংশের বেশি। পোশাক শ্রমিক বাহিনী ও রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তর তর করে বৃদ্ধি পাবে যদি সরকার প্রাইভেট প্রোজেক্টগুলোতে সহযোগিতা করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, অর্থ পাচারে সোচ্চার হয় এবং রাজনৈতিক ফ্যাক্টরের প্রতি গুরুত্বারোপ করে তাহলে বাংলাদেশ ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
"