মাহমুদুল হক আনসারী

  ০৭ অক্টোবর, ২০২২

বিশ্লেষণ

বিশ্বনবীর আদর্শেই মানবজাতির মুক্তি

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর পাঠানো সর্বশেষ নবী ও রাসুল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার অসাধারণ চরিত্র ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’

বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা শুধু কোরআন, হাদিস এবং মুসলমানরাই দেননি; বরং অমুসলিম মনীষীরাও দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম অমুসলিম মনীষী ‘মাইকেল হার্ট’ রচিত বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক প্রভাবশালী এক শ মনীষীর জীবনী গ্রন্থে সর্বপ্রথম বিশ্বনবীর জীবনী রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর সাফল্যের মধ্যে জাগতিক ও ধর্মীয় উভয়বিধ প্রভাবের এক অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে। এজন্য সংগতভাবেই তাকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’

মহানবী (সা.) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, বীরযোদ্ধা, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক, দক্ষ শাসক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। সব ক্ষেত্রে মানবজাতির জন্য তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। আমাদের উচিত, বিশ্বনবীর জীবনী বেশি বেশি অধ্যয়ন করা, তার জীবনী নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণা করা। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বনবীর সুন্নাহ ও জীবনাদর্শের প্রতি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা। সার্বিকভাবে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণের মাধ্যমে বর্তমান সমাজের অধঃপতন অবনতি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ মক্কার কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। জন্মের কয়েক মাস আগেই পিতা আবদুল্লাহ মারা যান এবং শিশুকালেই তিনি তার মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। মহান আল্লাহতায়ালার কৃপায় কিছুদিন দাদা আবদুল মুত্তালিব এরপর চাচা আবু তালিবের স্নেহে লালিতপালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন শিশু মুহাম্মদ (সা.)।

তার জন্মের সময় আরবের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। সে সময়ের মানুষ ছিল হানাহানি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, ব্যভিচার-ধর্ষণ, খুন খারাবিতে মত্ত। তারা ভুলে গিয়েছিল মনুষ্যত্ব। অজ্ঞতাণ্ডমূর্খতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। সুশিক্ষার আলো হারিয়ে অন্ধকারের আবর্তে নিমজ্জিত হয়েছিল। যে কারণে সেই যুগকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা জাহেলিয়াতের যুগ বলা হয়ে থাকে। বিশৃঙ্খলা, অজ্ঞতাণ্ডমূর্খতা, অনাচার-পাপাচার করতে করতে তখনকার মানুষ একেবারে জাহান্নামের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানবতার এই চরম দুঃসময়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহতায়ালা মুক্তির পথনির্দেশক মহাগ্রন্থ আল কোরআন দিয়ে জগদ্বাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শন করেন। জান্নাতের পথে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেন।

শিশুকাল থেকে তিনি ছিলেন শান্ত, নম্র-ভদ্র ও সৎচরিত্রবান। সত্যবাদিতার কারণে সে সময়ের লোকরা তাকে আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত করে। যুবককালে তিনি সমাজের কল্যাণে ব্রতী ছিলেন। সমসাময়িকদের সঙ্গী বানিয়ে তৎকালীন সময়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। ৪০ বছর বয়সে রাসুল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। নবুয়তপ্রাপ্তির পর তিনি মানুষকে কালেমার দাওয়াত দিতে লাগলেন। সর্বপ্রথম পরিজন ও নিকটজনদের মধ্যে ঘোষণা করলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’ মানুষকে বোঝালেন, এ কথাটি মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহতায়ালার বিধিনিষেধ মেনে চলার মধ্যেই ইহ-পরকালীন সুখণ্ডশান্তি নিহিত রয়েছে। এভাবে কালেমার বাণী প্রচার করে মানুষকে দ্বীনের পথে আহ্বান জানালেন প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালেমার বাণী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে নিকটজন ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্য থেকে হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-সহ অনেকেই কোনো ধরনের অজুহাত ব্যতিরেকে সানন্দে তা গ্রহণ করে নেন। মক্কার মূর্তিপূজক ও অগ্নি-উপাসকদের চরম বিরোধিতা ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মধ্যেও মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সুতরাং বর্তমান সময়ে যারা ইসলামের বিরোধিতা করেন, ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান- তাদের বলব, আপনাদের এই মনোবাসনা কখনোই পূর্ণ হবে না। আবু জেহেল, উতবা, সাইবা, উবাই, সুলুলরা পারেনি, আপনারাও পারবেন না। আপনারা যতই বিরোধিতা করবেন ইসলাম ততই প্রসারিত হবে। দ্রুতগতিতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। দিকে দিকে ইসলামের বিজয়নিশান উড্ডীন হবে। এক আল্লাহর বিশ্বাসে বিশ্বাসী হন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর পাঠানো সর্বশেষ নবী ও রাসুল হিসেবে মেনে নিন। যেনে রাখবেন, মুসলমানরা মহানবী (সা.)-কে নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে।

রাসুল (সা.)-এর কটূক্তি ও অবমাননা করে রাসুলপ্রেমীদের হৃদয়ে আঘাত করা হচ্ছে। আপনাদের জানা থাকা উচিত, কারো হৃদয়ে আঘাত করে নিজেরা সুখণ্ডশান্তিতে থাকার আশা করা বোকামি। চামচিকার ভর্ৎসনা যেমনিভাবে সূর্যের আলো একটুও দমাতে পারে না, কুকুরের ঘেউ ঘেউ পূর্ণিমার চন্দ্রের স্নিগ্ধতার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে না; তেমনি আপনাদের নিন্দা ও কটূক্তির কারণে মহানবীর একটুও অপমান হবে না। বরং তার শান-মান আরো বৃদ্ধি পাবে। ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি হবে। নবীপ্রেমী জনতার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। ইসলামের ইতিহাস থেকে এটাই প্রমাণিত।

আমাদের প্রিয়নবী (সা.) মক্কার মূর্তিপূজক ও অগ্নি-উপাসকদের বাধা, ষড়যন্ত্র, জুলুমণ্ডনির্যাতনের মধ্যেও তাওহিদের বাণী, মুক্তির পথনির্দেশক জীবনবিধান মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বাণী প্রচার করতে লাগলেন। মানুষকে তাওহিদের শিক্ষা-দীক্ষা দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সমাজের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। বিদ্বেষ পোষণকারীরা যতই বিরোধিতা করল ইসলাম ততই বিস্তৃতি লাভ করল।

নবুয়তের একাদশতম বছর ৬২২ সালের জুন মাসে মক্কার আবু জেহেল ও তার দোসরদের জুলুমণ্ডনির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবী (সা.) জন্মভূমি ত্যাগ করে মক্কা থেকে উত্তর দিকের ইয়াসরিব নামক শহরে হিজরত করেন। এই শহরের লোকজন দোজাহানের বাদশাহকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে বরণ করে নেন এবং তার দেখানো জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে আলোকিত করেন। মহানবী (সা.)-এর আগমনের ফলে ইয়াসরিব শহরের নাম হয়ে গেল ‘মদিনাতুন নবী’- যার অর্থ : নবীর শহর। প্রিয়নবী (সা.) তৎকালীন সময়ের সামাজিক অস্থিরতার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে তাগিদ দিলেন। খুন-খারাবির বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন, ‘মানুষ হত্যা মহাপাপ।’ এর করুণ পরিণতির কথা মানুষকে বোঝালেন। কোরআনে কিসাসের আয়াত নাজিল হলো- রাসুল (সা.) সমাজের লোকজনকে তা জানিয়ে দিলেন। ফিতনা-ফ্যাসাদ দূরীকরণে রাসুল (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘ফিতনা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ।’ ফিতনা-ফ্যাসাদ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, দুর্নীতির কুফল ও পরিণতির কথা মানুষকে বোঝালেন। যেনা-ব্যভিচার ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ব্যভিচার ও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান জারি করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে ব্যভিচারের শাস্তি এক শ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে এক শ বেত্রাঘাত ও রজম (‘রজম’ অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড)।’ বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ মানবজাতির জন্য একটি কালজয়ী জীবনচরিত্র। তার জীবনের মধ্যে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর জন্য শাশ্বত উন্নত চরিত্র রয়েছে। তার চরিত্রের মধ্যেই মানবজাতির চীরসুখ ও শান্তি নিহীত। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি জুলুম নির্যাতন নিষ্পেষণ তথা মানবজাতির মুক্তির জন্য মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শের বিকল্প নেই। আসুন আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকে অনুসরণ, অনুকরণ করি। বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে হে রাসুল (সা.) তোমাকে হাজারো সালাম।

লেখক : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close