মো. আরাফাত রহমান

  ০৬ অক্টোবর, ২০২২

অভিমত

শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ চাই

দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম বিদ্যমান। যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা, পেনসিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া, আনন্দচিত্তে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা সেই বয়সে ওই শিশুকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে একজন পিতা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হন, তখন ওই পিতার পক্ষে তার সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এভাবে একটি শিশু একবার পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর সে হারিয়ে যায় অগণিত মানুষের মধ্যে। এদের কেউ তখন হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কেউ ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে, কেউবা বাসাবাড়িতে কাজ নেয়।

উল্লিখিত কাজ ছাড়াও শিশুরা বাজারে বোঝা টানা, মিন্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রিকশা চালনা, ঠেলাগাড়ি টানা, বিড়ি বাঁধা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকে। কোনো কাজ না পেয়ে কেউ আবার ছিন্নমূল শিশুতে পরিণত হয়। সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এসব শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলো আর প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে এ শিশুরা সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে শিশুশ্রমের আরো একটি অভিশপ্ত দিক হলো, কর্মের প্রলোভন দেখিয়ে এক শ্রেণির প্রতারক একটি শিশুকে ঘর থেকে বের করে গ্রাম থেকে শহরে অবশেষে শহর থেকে বিদেশে পাচার করে। এভাবে পাচার হওয়া মেয়েশিশুদের পতিতাবৃত্তি ও পর্নোগ্রাফি এবং ছেলেশিশুদের বিভিন্ন অসামাজিক কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক দুরবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজে পরিবারের প্রধান তথা পিতার যদি মৃত্যু ঘটে তবে ওই পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া তো দূরের কথা, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করাই দায় হয়ে পড়ে। পারিবারিক ভাঙনে পিতা-মাতা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তাদের সন্তানদের খবর কেউ রাখে না। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারগুলোতে পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণ না করার কারণে সন্তান-সন্ততির সংখ্যাধিক্য হওয়ায় এদের ভরণপোষণে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো ভীষণ অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়। গ্রামে কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।

নদীভাঙন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে অহরহ। এ জাতীয় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনাই প্রতিনিয়ত শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে কায়িক শ্রমের দিকে। পিতা-মাতার স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অসচেতনতার কারণে তারা শিক্ষাকে একটি অলাভজনক কর্মকাণ্ড মনে করে। সন্তানদের ১০-১৫ বছর ধরে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য তখন তাদের থাকে না। শিক্ষা উপকরণ ও সুযোগের অভাব এবং শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের অসচেতনতা ও উদাসীনতায় শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর জীবনে গৃহস্থালির কাজে গৃহকর্মীর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা, গতানুগতিক সংস্কৃতির কারণে গ্রামে লেখাপড়ায় মগ্ন শিশুটিকেও নিয়ে আসা হয় শহরে বাসার কাজের জন্য।

বাংলাদেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য একটি নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা সরকারি-বেসরকারি পর্যায় তথা আপামর সুধীসমাজ দীর্ঘদিন ধরে অনুধাবন করে আসছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবন, সমাজ-সংস্কৃতি এবং সাম্প্রতিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনসমূহের আলোকে শিশুশ্রম পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপাদান এ নীতিমালায় সন্নিবেশ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমসহ সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করে তাদের জীবনের অর্থপূর্ণ পরিবর্তন সাধনই এ নীতির মূল লক্ষ্য।

জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি, ২০১০-এর লক্ষ্যসমূহ হলো : ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রত্যাহার, শ্রমজীবী শিশুদের দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে তাদের পিতা-মাতাদের আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ, শ্রমজীবী শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য বৃত্তি ও আনুতোষিক প্রদান, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা : বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, খরা ও মরূকরণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় আনা, আদিবাসী সম্প্রদায় ও প্রতিবন্ধী শিশুদের উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, শ্রমজীবী শিশুদের কল্যাণে নিয়োজিত সব সেক্টরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, শিশুশ্রম নিরসনে আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালীকরণ, শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পিতা-মাতা, সাধারণ জনগণ ও সুশীলসমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধীকরণ এবং শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ।

প্রধানত দুটি সেক্টরে বাংলাদেশে শিশুশ্রম বিরাজমান। (১) আনুষ্ঠানিক সেক্টর, যথা : শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা, জাহাজভাঙা ইত্যাদি। (২) অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, যথা : কৃষি, পশুপালন, মৎস্য শিকার/মৎস্য চাষ, গৃহকর্ম, নির্মাণকর্ম, ইটভাঙা, রিকশাভ্যান চালনা, মজুর, ছিন্নমূল শিশু ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বা কর্মে শিশুরা সাধারণত ছয়ভাবে নিয়োজিত থাকে : (১) প্রশিক্ষণার্থী; (২) বদলি; (৩) নৈমিত্তিক; (৪) শিক্ষানবিস; (৫) সাময়িক এবং (৬) স্থায়ী কর্মী।পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবিক অর্থে অল্প মজুরি দিয়ে অধিক কর্মঘণ্টায় নিয়োজিত রাখা যায় বলে শিশুদের শ্রমে নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকদের অধিক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো মজুরি ছাড়া পেটে-ভাতে বা স্বল্পতম শ্রমবিনিময় মজুরি নিয়ে শিশু-কিশোরদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-সংক্রান্ত যেসব উদ্যোগও কার্যক্রম এরই মধ্যে সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন তথা ইউনিসেফ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ (আইএলও) স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-সংক্রান্ত বিদ্যমান উদ্যোগসমূহের কার্যকর ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের জন্য সমন্বয় কার্যক্রম জোরদার করা আবশ্যক। এ ছাড়া, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম অনতিবিলম্বে গ্রহণপূর্বক তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নির্ধারণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমে নিয়োজিত একজন শিশু যদি : দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করে, এমন কাজ করে যা তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে, নিরাপত্তাহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে, বিনামজুরি, অনিয়মিত মজুরি, স্বল্প মজুরিতে কাজ করে, সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে, শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করে, বাধ্য হয়ে কাজ করে, ব্যক্তি মর্যাদা হেয় করে এমন কাজ করতে বাধ্য করে, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং বিশ্রাম বা বিনোদনের কোনো সুযোগ না পায় তাহলে, ওই কর্মপরিবেশ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তথা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অমর্যাদাকর।

শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, পরিত্যক্ত অনাথ শিশু এবং বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে এদের জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই শিশুদের কেউ যদি কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমে নিয়োজিত হয় তবে তাদের চাকরির শর্তাবলি স্বাভাবিক শ্রমজীবী শিশুর চেয়ে শিথিল করা এবং বিশেষ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও নিয়োগকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

শিশুশ্রমের মূল কারণ উদঘাটন ও নিরসনের সম্ভাব্য উপায় নির্ধারণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিশুশ্রম পরিস্থিতি, শিশুশ্রমের কারণ, প্রতিকারের উপায়, শিশুশ্রম নীতিমালা বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষ গবেষক সৃষ্টি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ আইন, বিধি ইত্যাদি কার্যক্রম সংস্কারের ক্ষেত্র নির্ধারণ এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। তা ছাড়া শিশুশ্রমের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোকে যতদূর সম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত জরিপের মাধ্যমে তথ্য আহরণ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন এবং আহরিত তথ্যের নির্ভরযোগ্য ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে।

সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশবের নিশ্চয়তা সব শিশুর জন্মগত অধিকার। শিশুর এ শাশ্বত অধিকার থেকে আমাদের দেশের অনেক শিশুই এখনো বঞ্চিত। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা জীবিকা অর্জনের তাগিদে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বা নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমে নিয়োজিত হয়, যা তাদের ঠেলে দেয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, সরকারি-বেসরকারি, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব মহল

প্রয়োজনীয় সম্পদ ও উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলে ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শিশুশ্রমসহ সব ধরনের শ্রম থেকে শিশুদের

প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে। শিশু ও শিশুশ্রমণ্ডসংক্রান্ত বিরাজমান আইন ও আইনের বিধিবিধানগুলোর যদি পুনর্বিন্যাস

এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায়, তবে আমাদের শিশুরা আগামীতে অবশ্যই আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল

ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close