মাহমুদুল হক আনসারী

  ০৫ অক্টোবর, ২০২২

অভিমত

ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি থাকা চাই

দেশ উন্নয়ন যে হচ্ছে এ কথা সত্য। কিন্তু এ কথাও সত্য, সাধারণ মানুষ দেশের অর্থনীতির যে অগ্রগতি তার সুফল পাচ্ছে না। দেশের মোট জনশক্তির বড় অংশ প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে বঞ্চিত। উন্নয়ন হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে সে অনুসারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। দেশে যে আর্থিক বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে তা অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। অন্যদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক কর্মসংস্থানের ওপর। প্রায় এক কোটির অধিক প্রবাসী যদি আর্থিক খাতে সব লেনদেন বন্ধ করে দিত তাহলে বাংলাদেশের এক থেকে দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হতো না।

আমাদের দেশে মানহীন শিক্ষা কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রের উন্নতির বড় বাধা। দেশের অর্থনীতিবিদ বিশিষ্টজনের মন্তব্য তাই। এটি শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে নয় আয় ও ভোগের ক্ষেত্রেও। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা ও আঞ্চলিক বৈষম্য। বছরে ৯৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাজারব্যবস্থায় আয় অনুপাতে ব্যয় বাড়ছে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। একটি ইতিবাচক দিক হলো, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের বয়স ২০২২ সালে ৫১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণার ওয়েলথএক্সের সর্ব সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, গত ৫ বছরে বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের বিবেচনায় সর্বশীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে আর কমেছে আয়। এক কথায়, টাকা এখন ব্যাগে করে নিয়ে যাবেন আবার ওই ব্যাগেই পণ্য কিনে ঘরে ফিরবেন। আমাদের অর্থনীতির মূল কাঠামোটা যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে মনে হচ্ছে দেশের চেহারার চেয়ে মানুষের চেহারার পরিবর্তন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বিগত কয়েক মাসে প্রায় কয়েক শ প্রকল্প অনুমোদনের যে হিড়িক লক্ষ করা গেছে তা অন্য কোনো দেশে লক্ষ করা যায় বলে মনে হয় না।

বাস্তবে দেশের জনগণ এসব উন্নয়নের কতটুকু অংশীদার হতে পেরেছে এবং এদের শতাংশ হার কত, এসব বিবেচনায় রাখতে হবে। এখন ৫০০ টাকা বাজারে নিয়ে গেলে শুধু সবজি কিনে বাসায় ফিরতে হয়। ঘুষখোর, লুটেরা এবং দুর্নীতিবাজদের টাকা যোগ করলে মাথাপিছু গড় আয় যথার্থ বলা যায়। কিন্তু তাদের টাকা বাদ দিলে ৭০০ ডলার মাথাপিছু গড় আয় হবে বলে মনে হয় না। আয়-রোজগার ভালো হলে সারা দেশে ভিক্ষুক-মিসকিনদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। পাশাপাশি হকারদেরও জ্বালাযন্ত্রণা বাড়ছে। ফুটপাত দখল এমনকি পরিবহন, মসজিদ, মাদ্রাসা সব জায়গায় এদের উৎপাত লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। বর্তমানে সরকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সেই হিসাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে থাকে প্রতি বছর বেতন কত বেড়েছে। যদি দেখে শতকরা ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তখন ব্যবসায়ীরা যৌথ উদ্যোগে শলাপরামর্শ করে বাজারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী মহল জড়িত থাকে বিধায় অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে গত দুই বছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ধাক্কা লেগেছে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। ফলে ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে বেশি, রাষ্ট্রের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় অনেক দিন ধরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স সরকারের ঘাটতি বাণিজ্য নিয়েই চলেছে।

সম্প্রতি সরকারি রাজস্ব বিভাগ আয়কর বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাইকিং করে জনগণের বাসাবাড়িতে জানান দিচ্ছে বিদেশ থেকে আর ঋণগ্রহণ নয় নিজের আয়ে দেশ চালাব। কর দিলে ঋণ কমবে, মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন। সাধারণ মানুষের যে আয় সে তো আয়করের আওতায় পড়ে না। কর যারা দেবেন তারা দিচ্ছেন ফাঁকি। এরা নানাভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির করে যাচ্ছে। উপার্জিত কালোটাকা তারা কোথায় বিনিয়োগ করছে তা অনুসন্ধান করুন। কর মেলা করে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব নয়। উদীয়মান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওতায় আনুন। অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করুন এবং কালোটাকার ওপর কর ধার্য করুন। আমদানির এবং রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্যযুক্ত একটি অর্থনীতি দেশের জন্য অতীব জরুরি।

নানাভাবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে আমজনতার মধ্যে তাদের জীবনযাপনের মধ্যে অর্থনীতি সফলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মুষ্টিময় একটি শ্রেণির কাছে অর্থনীতির চাকা সীমাবদ্ধ। ফলে আমজনতা জাতীয়ভাবে অর্থনীতির সুফল পাচ্ছে না। ক্রমেই জাতীয় অর্থনীতি কঠিন হচ্ছে। এভাবে জাতীয়ভাবে অর্থনীতি চলতে পারে না। রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোর মধ্যেই সমন্বয় থাকা চাই। বর্তমানে দুটিতেই অস্থিরতা চলছে। অবশ্যই এসব অস্থিরতা দূর করতে হবে। রাজনীতিতে সব পক্ষকে নিয়ে সমন্বয় করতে হবে। স্থিতিশীল রাজনীতি এবং পরিবেশ জনগণের কাম্য। তবেই অর্থনৈতিক সুফল জনগণ পেতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close