মো. আতিকুর রহমান

  ০৫ অক্টোবর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষরোপণ জরুরি

বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ও জলবায়ু হুমকির মুখে পড়ছে। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ পতিত হচ্ছে। বিপরীতে নিজের প্রয়োজনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে কতটুকু সচেতন হতে পারছি সেটিই আসলে ভাবনার বিষয়।

যদিও সবাই জানি, গাছ ও পরিবেশের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক অন্তর্নিহিত। গাছ আমাদের পরম বন্ধু। কিন্তু আমরা কতটুকু যত্নশীল ওই বন্ধুর প্রতি? আমরা কোনো কারণ ছাড়াই অথবা সামান্য কারণেই গাছপালা কেটে ফেলছি, বন উজাড় করে ফেলছি। কিন্তু একটা দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করছে আমরা কতটুকু দায়িত্বশীল হয়ে সেই গাছপালা রক্ষা করতে পারছি! এমন এক বাস্তবতায় নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে আমাদের সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রত্যেকেই যেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে বৃক্ষরোপণে অধিক মনোনিবেশ করতে পারি এজন্য যে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, যা এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি।

পরিবেশ রক্ষায় গাছপালার ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্যেকটি প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৃক্ষ বা উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। এক কথায় বৃক্ষ ছাড়া পৃথিবীতে জীবজগৎ অকল্পনীয় ব্যাপার। আর এই পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষের ভূমিকা ব্যাপক তা সবাইকে মনে রাখতে হবে। বৃক্ষ বাতাসে বিভিন্ন গ্যাসের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বাতাসে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেশি হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, কারণ ওই গ্যাস তাপ শোষণ করে রাখে। বর্তমানে গ্রিন হাউস ইফেক্ট নামে যা সুপরিচিত। বৃক্ষ

বাতাস থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে গ্রিন হাউস ইফেক্টের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে বাতাসে অক্সিজেন যোগ করে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত বজায় রাখতে সাহায্য করে। এভাবে বৃক্ষ বায়ুদূষণ কম করে বাতাস বিশুদ্ধ রাখে। বৃক্ষ বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। বৃক্ষের অভাবে উর্বর উৎপাদনশীল মাটি ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়। মাটির উর্বরতা বজায় রাখার জন্য দরকার বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাত ঘটাতে আবশ্যক গাছপালা।

শুধু তাই নয়, ভূমিক্ষয় রোধে গাছের ভূমিকা অনেক। বৃষ্টির প্রচণ্ড গতি ও শক্তিকে প্রশমিত করে ভূমিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে। গাছপালার শিকড় মাটিকে আঁকড়ে বেঁধে তার ক্ষয়রোধ করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে গাছপালা অপরিহার্য। অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা গাছই করে থাকে। গাছপালা থেকে মানুষ খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, গৃহনির্মাণ ইত্যাদি তো পেয়েই থাকে। অন্যদিকে গাছপালা পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে মানুষের মনে আনন্দ দান করে। পরিবেশ দূষণ কমিয়ে এবং পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে উদ্ভিদ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ের উন্নতিতে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বর্তমানে আমরা যে পরিবেশ সংকটে ভুগছি তার জন্য আমরাই দায়ী। তাই এ সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রত্যেকেরই কিছু করণীয় আছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকীকরণ ইত্যাদির ফলে পরিবেশ সংকট বেড়েই চলেছে। অথচ শিল্পায়ন-নগরায়ণের গতি থামানো বা কমানো মোটেই সম্ভব নয়। তাই দরকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা। এ ক্ষেত্রে বৃক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উদ্ভিদের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষই কিছু অবদান রাখতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত প্রতি বছর বৃক্ষরোপণের মৌসুমে বাড়ির আশপাশে কিংবা খোলা জায়গায় সাধ্যমতো গাছ লাগানো। তবেই পরিবেশ ভালো থাকবে। ভালো থাকবে আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য।

যদিও বাস্তবতা জনসংখ্যার চাপে বনভূমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ কমে আসায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে আবহাওয়ায়। বৃক্ষনিধনের ফলে বাতাস দূষিত হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে মাটি। পরিবেশ আজ সংকটের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। ফলে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতুলনীয় সবুজ সৌন্দর্য। মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্বের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বনাঞ্চল একদিকে নিসর্গে শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করছে। বনভূমি বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। তা ছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে।

তথ্য মতে, একটি দেশের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দর বন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বনভূমি, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল। সুন্দরবন বাদ দিলে বন বলতে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই নগণ্য। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের মতে, এর পরিমাণ মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ। যেখানে ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে ৯৬৪ জন মানুষ। ২০১০ সালের শ্রমিক জরিপে দেখা যায়, মোট বেসামরিক শ্রমিক ৫৭.১ মিলিয়ন এবং এর মধ্যে বিশাল একটি অংশ বনজসম্পদ সৃষ্টি কিংবা বনজসম্পদনির্ভর উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। ২০১১-১২ সালের বসতবাড়িভিত্তিক বনজ জরিপে দেখা যায়, বননির্ভর কর্মকাণ্ডে ৭.৪২ মিলিয়ন শ্রমিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছেন। ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৩.১৯ শতাংশ বৃক্ষাচ্ছাদন এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। একসময় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৮টি জেলায় কোনো বনায়ন কার্যক্রম ছিল না। এখন প্রায় সবকটা জেলাতেই সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা ইতিবাচক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে সবাইকে বৃক্ষরোপণের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে রয়েছে বনায়নের বিপুল সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে সবাইকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। পরিকল্পিত একটি বাগানেই হতে পারে আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আয়ের উৎস। এই ধ্যান-ধারণা সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশ গড়ে তুলতে হলে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে গাছ নিধন নয়, সৃজনই হোক সবার লক্ষ্য- যা জরুরি। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের প্রতি সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে সবাইকে বৃক্ষপ্রেমিক হতে হবে। এ কাজে প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছা আমাদের ভবিষ্যৎকে করতে পারে সুন্দর। উপহার দিতে পারে একটি নান্দনিক পৃথিবী, যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই কাম্য।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close