আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা
মুক্তমত
মাথা গোঁজার ঠাঁই ওদের ওটুকুই
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলি অত্যন্ত মর্মান্তিক। মৃত্যুঝুঁকির কারণে বাংলাদেশ সরকার নাগরিকদের বলেছে দায়িত্বশীল আচরণ করতে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করবেন মানুষ? সরকার কর্তৃক লকডাউন ঘোষণার কারণে মানুষ নিজ নিজ গৃহে বন্দি ছিলেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে এবং পাড়া, মহল্লা ও দোকানে জটলা পাকাতেও বারণ করেছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরের মধ্যে যে জটলা ঘনীভূত হয়েছে তার সমাধান কী? তা দেখার কি কেউ আছে? তাই কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় এটা বলা প্রাসঙ্গিক বটে, ‘স্থানের অভাব এ জগতে নাই, তবু মাথা গুঁজিবার ঠাঁই এদের ওটুকুই’।
মানবজাতির এই চরম দুঃসময়ে বাংলাদেশব্যাপীও মানসিক অন্ধত্ব মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে, স্থিরচিত্রটি দেখে তাই মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানবতার অবক্ষয়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন, জীবিকা ও মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করার বিষয়গুলো নিয়ে তেমন দৃশ্যমান ইতিবাচক কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। চলমান করোনাভাইরাস মহামারির শিক্ষা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষের চেয়ে এই ঢাকা শহরে যান্ত্রিক যানবাহনের মূল্য বা দাম অনেক বেশি। বিভিন্ন জায়গায় (বিশেষ করে, বাসাবাড়ির নিচতলা, অফিস ও মার্কেটে) যেভাবে আইন ও নীতিমালা করে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা দখল করে রেখেছে। যদিও মানুষের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার আবাসন (বসতি) নিশ্চিতকরণসহ বাসযোগ্য ও নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব বসতি দিবস’ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব বসতি দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এ বছরও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়। এবারের বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘Mind the gap, Ieave no one and place behind’, অর্থাৎ ‘বৈষম্য হ্রাসের অঙ্গীকার করি, সবার জন্য টেকসই নগর গড়ি’ এবং ২০২১ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘নগরীয় কর্মপন্থা প্রয়োগ করি, কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ি’। আবাসনের বৈষম্য দূর করতে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান বন্ধ করে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য মাথা গোঁজার স্থান অনেকাংশে নিশ্চিত করা ছাড়াও বর্তমান বাস্তবতায় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতাও কমিয়ে আনা ও কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়া সম্ভব।
সরকারের কাছ থেকে আইনগতভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সৌভাগ্যক্রমে ‘মহাপরাক্রমশালী’রা সাহায্য পাচ্ছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন বাঁচাতে মাথা গোঁজার স্থানটুকু পাচ্ছেন না রাষ্ট্রের কাছ থেকে। নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জায়গার অপ্রতুলতা রয়েছে, তার মধ্যে সংসার বাড়লে রুমের মধ্যে পার্টিশন বাড়ে এবং তলা করা হয়। ‘আইন শুধু ধনী মানুষের কল্যাণের জন্য’ জনৈক দার্শনিকের এই উক্তি সত্যে পরিণত হলো। এ ছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে এই অবস্থার জন্য। তা হলো : যিনি ধনী ব্যক্তি ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন, তিনিই সংসদ সদস্য এবং তিনিই মাননীয় মন্ত্রী মশায়। এজন্য যখনই আইন ও নীতিমালা করেন, তাদের স্বার্থের বিষয়টি সব সময় তারা মাথায় রাখেন, জনস্বার্থ নয়। এসব আচরণ আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপ্নকে পদদলিত করছেন। মেলভিন পি. গাইকস, Administration of Injustice বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, সমতা না থাকলে কোনো জাতি বাড়তে পারে না এবং সমণ্ডন্যায়বিচার ছাড়া যেকোনো সমাজ নিজেই নিঃশেষ হতে বাধ্য। আইন থাকতে হবে এবং সে আইন হতে হবে ন্যায়বিচারের ধারক। আর ন্যায়বিচার হতে হবে সবার জন্য।
ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে, শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য প্রায় ১২০ ফুট জায়গা প্রয়োজন এবং সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ওই জায়গা বরাদ্দের আইন করা আছে। আবার দেখুন, দশ বাই দশ ফুট একটি কক্ষে কতজন মানুষ বসবাস করছে, এদের না আছে বারান্দা, না আছে আঙিনা। এদের পয়ঃপ্রণালির অবস্থা আরো শোচনীয়!! কোভিডকালে আর যেহেতু নিম্ন আয়ের এসব দিনমজুর ও গৃহকর্মীর কাজ ছিল না, তাই এরা আরো বেশি (তথাকথিত ঘর নামক) ওই কক্ষটিতে বন্দি কয়েদির মতো; যা এই লকডাউনের সময় তাদের জনস্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য মতে, ৩৩০৯৬৮টি নিবন্ধিত জিপ ও ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৮ কোটি বর্গফুট জায়গা লাগে। সরকার চাইলে গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে ওই জায়গায় ৫৩ লাখ নিম্নবিত্তের আবাসন চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। এজন্য দরকার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানা মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের। ৯৫ শতাংশ মানুষের মৌলিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা প্রদান কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন বাঁচাতে মাথা গোঁজার পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় স্থান না থাকার ফলে নিজেরাই নিজেদের জন্য একটি বড় আপদে পরিণত হয়েছে, সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য না পেয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের তুলনায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার অবস্থা অনেক বেশি ভালো। ধনীরা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা পেলেও নিম্ন আয়ের মানুষের মাথা গোঁজার স্থানটুকু পাচ্ছে না, এটা ভিন্ন কিছুর আভাস দেয়। এই রাষ্ট্রটি কি শুধু ধনীদের জন্য! মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ কি ধনীরাই করেছিলেন!! এ রকম বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র তৈরির জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম? ৩০ লাখ জীবনকে উৎসর্গ করতে হয়েছিল!!
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকটি ব্যক্তির জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার আছে।’ এবং ২৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মানসম্পন্নভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, যেটি তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ির কথা কোথাও বলা হয়নি। জীবনের অধিকার ও জনস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হলেও রাষ্ট্র কেন এই দিকে সুদৃষ্টি দিচ্ছে না।’ এ ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদের ভাষ্য হচ্ছে- ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন’; কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে নগণ্য করে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার বৃদ্ধিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
রাষ্ট্র ও ধনী ব্যক্তিরা জানে, কি করে নিজেরা দোষী হলেও নিজেদের বাদ দিয়ে অন্যকে দায়ী করতে হয়, সাক্ষ্য আইনের এক্সকালপেটরি সাক্ষ্যের মতো বলা যায়। কিছু মানুষ প্রশ্ন করবেন, কেন শহরে এই নিম্ন আয়ের মানুষের চাপ? কেউ কেউ পরিবেশ উদ্বাস্তু হয়ে, কেউবা তথাকথিত উন্নয়ন উদ্বাস্তু হয়ে অথবা অনেকে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে নিজ নিজ পূর্বপুরুষের ভিটা-মাটি হারিয়ে ও ছেড়ে এবং কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে জীবিকার সন্ধানে এই শহরে স্রোতের বেগে ছুটে আসছে। তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই বলে কি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য মাথা গোঁজার স্থানটুকু নিশ্চিত করবে না!
প্রকৃতি যত বড় নির্মম, রাষ্ট্র তার চেয়ে বড় বেশি নির্মম!! উন্মুক্ত ও উদার পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষগুলোর নিজেদের প্রবঞ্চনা ও দুর্দশা ভালোভাবে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ভাষায় বলা যায়, ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামের, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’। কারণ ঈশ্বর এখানে থাকেন না। জনসাধারণ হিসেবে আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের দায়ী করা। আসলে, ওইসব আচরণ মানবাধিকারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লঙ্ঘন। তাই রাষ্ট্রকে এখনই জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান রইল।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট
"