দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
অভিমত
জাতিসংঘে শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণদানকালে রোহিঙ্গা সমস্যা এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে আলোকপাত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে দেশটিতে চলমান অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মানব পাচার, মাদক চোরাচালানসহ আন্তসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি তা উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সংকট
প্রলম্বিত হলে তা এ উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
প্রধানমন্ত্রী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা এবং খাদ্য সংকটের বিষয়টিও তার বক্তব্যে তুলে ধরে বলেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী-শিশুসহ গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বিশ্ব মানবজীবনের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সাইবার অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধান ব্যতীত টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখেছি, বিশ্ব যখন করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় রত, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি; অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বাস্তবায়ন। কাজেই এ সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে, তার একটি দিকনির্দেশনাও প্রদান করেছেন। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা দেখেছি, বিশ্বের অন্যতম খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী এ দুটি দেশ থেকে অন্য দেশে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছিল। পরে এ সংকট কিছুটা কাটলেও খাদ্য সংকট পরিস্থিতি এখনো অব্যাহত আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যের দাম। নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। হুমকির মুখে পড়েছে জ্বালানি নিরাপত্তা। আর এসবের ফলে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো এবং এর জনগণ। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আলোকে জাতিসংঘ ও বিশ্বনেতাদের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার পরও বাংলাদেশ সংঘাতে জড়ানোর বদলে পাঁচ বছর ধরে প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করছে। আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে জাতিসংঘকে সক্রিয় হতে হবে। বিশ্ববাসীর স্বার্থেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অবরোধ-পাল্টা অবরোধ বন্ধেও নিতে হবে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের সামনে দুর্যোগের সংকটপূর্ণ সময়ে সমাধানের সূত্র তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার প্রভাব এবং স্বার্থগত সংঘাতকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবমুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা পরিহার করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই আহ্বান বিশ্বশান্তি ও মানবমুক্তির দিকদর্শন। প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণে বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মর্মবাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
"