আবদুর রউফ

  ০৩ অক্টোবর, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

সমন্বয়হীনতার দ্বিধা দ্বন্দ্বে জনজীবন

বাংলাদেশকে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বলা হয়। এই অঞ্চলের গঠন ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় অধিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। সারা বছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে এ দেশের সিংহভাগ মানুষকে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অনাবৃষ্টি ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আতঙ্ক নিয়েই জীবিকার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে দেশটিকে ঠাট্টা করে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ। সেই দেশটি সময়ের আবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বহির বিশ্বে নানা কারণে বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র প্রশংসিত হচ্ছে।

পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট, মানুষের জীবন যাত্রার মান আগের থেকে অনেকটাই উন্নত হচ্ছে। তবে সেই উন্নয়নের সুফল দেশের প্রতিটি মানুষ পাচ্ছে কি-না তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। একদিকে উন্নয়নের জোয়ার। অন্যদিকে খেটে খাওয়া গরিব মানুষ বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের হাহাকার বেড়েই চলছে। চক্রবৃদ্ধি হারে দেশে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও গরিবের সংখ্যাটাও বাড়ছে সমান তালে। ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার একটি ছোট দেশে এত অধিক পরিমাণ জনসংখ্যা বিশ্বের আর কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদিও এবারের জনশুমারি ও গৃহগণনার রিপোর্ট নিয়ে সংশয় রয়েছে।

প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে দেশের মোট বাসগৃহের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৯৫১টি। একইসঙ্গে ছিন্নমূল বা ভাসমান মানুষ আছেন ২২ হাজার ২১৯ জন। যদিও ভাসমান অর্থাৎ বাস্তুহারা মানুষের এই সংখ্যাটি বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ করোনা ও তার পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা এবং মানুষের অভাব অনটন অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে এই সংখ্যাটি নিছক সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাস্তব সংখ্যাটি এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। কেননা বিশ্বব্যাংক ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। আর বিশ্বে ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতিগরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে। আর নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বিবেচনায় এই সংখ্যা ৮ কোটি ৬২ লাখ। এই পরিসংখ্যানটি কয়েক বছর আগে করা। পরে করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশের গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পরিসংখ্যানগতভাবে কাগজে-কলমে এগিয়ে গেলেও বাস্তবিক অর্থে কতটা এগোতে পেরেছে তা নিয়ে বেশ সমালোচনা রয়েছে। কেননা করোনা পরবর্তী সময় থেকে শুরু হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিনিয়ত প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে একবারেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিটি পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি যে যার ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার অন্যতম বড় কারণ সমন্বয়হীনতা। সেইসঙ্গে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেট।

বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টর একটি আরেকটির পরিপূরক। দেশের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা শুরু থেকেই দৃশ্যমান ছিল। তবে দেশবাসী সেটির ভয়াবহ রূপ দেখেছে কোভিড-১৯ চলাকালীন। কোভিড-১৯ চলাকালীন লকডাউন, বিধিনিষেধ, পরিবহনের ভাড়া ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে যে ভয়াবহ সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে তা আমাদের সবারই জানা। কোভিড-১৯-এর অজুহাতে বৃদ্ধি পাওয়া দ্রব্যমূল্যের দাম আর কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে দাম আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পণ্যটির দাম কোনোভাবেই বাড়ানোর উচিত নয় সেটিরও দাম বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কয়েকবার জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরে যে সমন্বয়হীনতা চোখে পড়েছে তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। পরিবহন সংশ্লিষ্ট বলছেন, জ্বালানির তেলের দাম বৃদ্ধির কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করার প্রস্ততি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু প্রতিবারই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হেটেছে উল্টো পথে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো সমন্বয় না করে শুধু প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মধ্যরাতে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি পণ্যে উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। অথচ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় শুধু দাম বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এই সমন্বয়হীনতার কারণে পরিবহন সেক্টরসহ প্রতিটি জায়গায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে এটি সত্য। কিন্তু দেশের প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে এই যুদ্ধের অজুহাতকে ব্যবহার করা হচ্ছে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয় চলছে আপন গতিতে। কারো সঙ্গে কারোই সমন্বয় নেই। যে কারণে জনজীবন আয় ও ব্যয়ের সমীকরণে অসহনীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছে। জীবনের ব্যয়ভার বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি মানুষের আয়। যে কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে অসৎ পথকে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। মনে করুন একজন সাধারণ সরকারি কর্মকর্তা ২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। তার এই আয়ে ১০ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারটি পরিচালিত হয়। করোনা শুরুর পূর্বে এই টাকা দিয়ে পরিবারটির ব্যয়ভার বহন করা গেলেও বর্তমান সময়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। নানা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তার বেতন ২৫ হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ। ফলে অতিরিক্ত অর্থ জোগান দিতে হয় তাকে ঋণ অথবা অসদুপায়ের পথে অবলম্বনে অর্থ আয়ে পা বাড়াতে হচ্ছে। ফলে দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরি অর্থের নেশায় অনেকেই নিজেদের বিবেক ও দায়িত্ববোধকে বিক্রি করে দিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে।

সংসার পরিচালনা করতে গিয়ে অভিভাবকরা পড়ছে বিপাকে। রাষ্ট্রের সমন্বয়হীনতার প্রভাবে দেশের অসংখ্য মানুষ কষ্ট করে জীবনযাপন করছে। হয়তো সেই আগের মতো মানুষ না খেয়ে না থাকলেও তাদের প্লেটে খাবারের পরিমাণ কমে গেছে। অর্থাৎ আগে পেট ভরে তিন বেলা খেতে পেলেও এখন এক বেলা বা দুবেলা খেয়ে মানুষ জীবন পার করছে। এই অস্বাভাবিক সমন্বয়হীনতার কারণেই দেশ আজকে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। এত অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠী থাকার পরও সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয় না থাকার ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলছে। তাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে সরকারের প্রতিটি খাতকে সমন্বয় করে দ্রব্যমূল্যের মান ও দাম নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের যে উন্নয়ন সেই উন্নয়নের সুফল যেন সমবণ্টন হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শুধু একটি বিশেষ শ্রেণি এই উন্নয়নের সুফল পেয়ে বিলাসী জীবনযাপন করবে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তাই আসুন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রবিনির্মাণে সবাই এগিয়ে আসি। সেজন্য প্রয়োজন ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া। সেই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে একটি বৈষম্যহীন অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত করা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সমন্বয়ে দেশ পরিচালিত করা। দেশের সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে সেটি নিশ্চিত করা। সব ক্ষেত্রে থাকবে সমন্বয় করে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা- এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close