মো. জিল্লুর রহমান

  ০২ অক্টোবর, ২০২২

বিশ্লেষণ

প্রবীণরা বোঝা নয় সমাজের বটবৃক্ষ

মানুষের জীবনে বার্ধক্য এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা কারণে বার্ধক্যের জীবন খুবই কঠিন হয়, হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে বর্তমানে ৬০ বছর বা এর অধিক বয়সি মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি ১০ লাখ। ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২১০ কোটিতে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বয়সে তাদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা কেমন হবে, তা নির্ভর করবে তারা কোন দেশটিতে বসবাস করছেন তার ওপর।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ প্রবীণ এবং মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তারা সমাজের বোঝা নয়, তারা সমাজের সম্পদ; তাদের এ দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এ প্রবীণরাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অভিভাবক। বলা হয়, ওল্ড ইজ গোল্ড অর্থাৎ প্রবীণরা হলো স্বর্ণ বা সমাজের বটবৃক্ষ। বাংলাদেশের সনাতনী শিক্ষায় প্রবীণদের অর্থাৎ পিতা-মাতা ও গুরুজনদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, সেবা-শুশ্রƒষা করার প্রতি একসময় আগ্রহ সৃষ্টি হতো। পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনে প্রবীণদের সেবা, যত্ন করার অনুপ্রেরণা ছিল; যা আজ তথাকথিত আধুনিকতার আঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে। অথচ এ প্রবীণরাই তাদের সারা জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দিয়েই সঠিক পথনির্দেশ করে থাকেন। সমাজকে আলোকিত করেন। দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে তাদের অবদান অবিস্মরণীয় ও অসীম।

শিল্পোন্নত দেশে ৬৫ বছর বয়সি ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সি ব্যক্তিরা প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত। মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে সেটি প্রবীণপ্রবণ সমাজ (এজিং সোসাইটি) হিসেবে গণ্য। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা তার বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণপ্রধান সমাজ (এজড সোসাইটি) বলে স্বীকৃত। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী এ দেশে প্রবীণদের এই সংজ্ঞাই মেনে চলা হয়। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের সমাজে দৃশ্যমান সফল প্রবীণ ছাড়া অন্য প্রবীণরা সাধারণত পাদপ্রদীপের আলোয় থাকেন না। এমনকি পরিবারের কাছেও তারা অনেকটা অবহেলার পাত্র হয়ে থাকেন। এই অবহেলার কারণ দুটি। প্রথমত, আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও সন্তানরা ভৌগোলিক দূরত্বে বসবাস করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানসিক দূরত্বও থাকে। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারগুলোতে সন্তান-সন্ততির সদিচ্ছা থাকলেও অসচ্ছলতার কারণে বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা পিতামহ-পিতামহী, মাতামহ-মাতামহীর প্রয়োজনমাফিক এগিয়ে আসতে পারে না।

উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হলেও এর অনেকটা বিপরীত চিত্র দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ২০১৫ সালে ‘গ্লোবাল এজ ওয়াচ ইনডেক্স’ ৯৬টি দেশে জরিপ চালিয়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সেবা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক যোগাযোগ এসবের ভিত্তিতে ১০টি দেশকে সেরা হিসেবে বেছে নিয়েছিল? প্রবীণদের জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো দেশ সুইজারল্যান্ড। কারণ ইউরোপের এই দেশটিতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও তাদের যথাযথ পরিবেশের ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন নীতিমালা ও কর্মসূচি রয়েছে। এখানে ৬০ বছরের একজন মানুষ আরো ২৫ বছর বেঁচে থাকার প্রত্যাশা রাখেন। প্রবীণদের সামাজিক সংযুক্তি এবং নাগরিক স্বাধীনতার দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের স্থান শীর্ষে। দেশটিতে ৬৫ বছরের অধিক বয়সিদের শতভাগ পেনশন দেওয়া হয়। এরপর রয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস। তবে ইউরোপের বাইরে প্রবীণবান্ধব দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে এশিয়ার দেশ জাপান। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে জাপানে বয়স্কদের হার বিশ্বের সর্বাধিক। দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। এখানে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা খুবই চমৎকার। ৬০ বছরের একজন মানুষ আরো ২৬ বছর বেঁচে থাকার আশা করেন। এ দেশে সামাজিক সংযোগ, নিরাপত্তা এবং নাগরিক স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে প্রবীণদের উচ্চ সন্তুষ্টি রয়েছে।

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই জনশুমারির তথ্য বলছে, দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সি মানুষ ৯৭ লাখ ২৭ হাজারের কিছু বেশি এবং তারা মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জনশুমারি বলছে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলছে, ২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। ইউনিসেফের এক রিপোর্ট বলছে, দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হবে।

বর্তমানে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ৫৭ লাখের বেশি মানুষ বয়স্ক ভাতা পান এবং প্রতি মাসে এদের প্রত্যেককে ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়। সরকারের এই পরিসংখ্যান দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা বেশ বড়। সরকারি হিসাবে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যাদের বয়স সত্তরের বেশি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে প্রবীণ বা বার্ধক্য এমন একটা বিষয়, যেটা কেউ বুঝতে চান না, জানতে চান না, শুনতে চান না। প্রবীণদের কষ্টের কোনো সীমা নেই, বিশেষ করে নারী প্রবীণদের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি কষ্টকর। বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই প্রবীণদের অবজ্ঞা এবং নিগ্রহ করার বিষয়টি কম বেশি বিরাজমান। শহুরে উচ্চবিত্ত সমাজে প্রবীণদের অবহেলা এবং বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে বেশি। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মধ্যে অবহেলার ধরন ভিন্ন রকম। মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন প্রবীণকে দেখাশোনা এবং সেবা করার জন্য যে ধরনের জনবল এবং আর্থিক সামর্থ্য দরকার সেটি অনেকের থাকে না। এর ফলে ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবারের কাছে অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। তবে অনেক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে প্রায়ই পিতামাতাকে নিগ্রহের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যে পিতামাতা তাদের জীবন-যৌবন সবকিছু ছেলেসন্তানের সুখণ্ডশান্তির জন্য বিলিয়ে দেন অথচ বৃদ্ধ বা প্রবীণ বয়সে এদের জোরজবরদস্তি করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। এটা সমাজের জন্য বেশ উদ্বেগজনক চিত্র।

তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন’ প্রণয়ন করে। এই আইনে পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তার পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোথাও আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। এই আইনে পিতা-মাতার জন্য ভরণপোষণ এবং চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি সন্তানরা এসব দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সেক্ষেত্রে এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন।

মূলত প্রবীণরা হলো জীবন্ত ইতিহাস; যা অতীত ও বর্তমানের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। তাই এসব জ্ঞানের ভা-ারকে অবহেলা না করে বরং তাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে দেশে এবং জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রবীণদের কল্যাণে আমাদের অতীতের গৌরবময় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য বলা হয়, প্রবীণরা সমাজের বটবৃক্ষ, তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা নবীনের চলার পথের পাথেয়। প্রবীণ ব্যক্তিটি আমাদের পরিবার, সমাজ, দেশের কল্যাণে অনেক অবদান রেখেছেন। তাই এখন সময় এসেছে নবীনদের প্রবীণ ব্যক্তিটিকে তার যথাযথ সম্মান, সেবা, সব ধরনের সহযোগিতা করা। এটা ভুলে গেলে চলবে না, আজকের নবীন এক দিন আপনিও হবেন প্রবীণ। বর্তমানের এই শহরের যান্ত্রিক জীবনে একজন প্রবীণ সবার জন্য আশীর্বাদ, তাই নয় কোনো অবহেলা, চাই প্রবীণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close