নবনীতা চক্রবর্তী

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

সাফ চ্যাম্পিয়ন মাতৃপক্ষের বোধন

যারা প্রকাশ্যে বলে ৭৫-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, যারা বলে বর্তমান সময়ের চেয়ে নাকি পাকিস্তানি আমল ভালো ছিল, এসব শুনে, দেখে-বুঝে মাঝেমধ্যে কপালে ভাঁজের চিহ্ন দেখা দিলেও গত দুদিনের বাংলার অদম্য মেয়েদের দুরন্ত জয়ে শিরদাড়া কেমন সোজা হয়ে উঠল। ফুতকারে উড়ে গেল সমস্ত চিন্তা। দ্বিধার পাহাড় ভেঙে চুর চুর। যে আগামীর বাংলাদেশের বীজ বুনে যাই অবিরাম সেখানে এমন যোদ্ধাদের বিজয় আমাদের শুধু সুখ দেয় না দেয় সাহস আর আত্মবিশ্বাস। সাফ চ্যাম্পিয়ন আমাদের বাংলার মেয়েরা। ‘আহা কি আনন্দ/আকাশে বাতাসে/গাছে গাছে পাখি ডাকে/কত শোভা চারিপাশে।’

মানুষের কলতানে আবেগে আর উচ্ছ্বাসে, উল্লাসের মহাসমারোহ বাংলাদেশ দেখল। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এক দিন কূপমণ্ডূকররা নারীদের বন্দি করতে চেয়েছিল হাজার গায়েবি ফতোয়ার অজুহাতে আর সেখানেই আজ জনতা বাঘিনিদের বরণ করেছে মহানন্দে। এ থেকে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বাংলার ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণ সেই ধর্মজীবীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ দেখল সব কাঁটা চূর্ণ করে কী করে ফুল হয়ে উঠতে হয়। মেয়েরা যেন শিকল পরেই সেই শিকল ভাঙাটা আমাদের হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল। চোখে আঙুল তুলে দেখাল বাধার পাহাড় জয় করা কাকে বলে। কত দীর্ঘ অনুশীলন, কত পরিশ্রম, কত চোখের জল, কত রোদণ্ডবৃষ্টি, কত দিনবদলের খেলা দেখেও নীরবে মুক্তো ফলানোর কাজটি তারা করে গিয়েছেন। মেয়েরা এক বোমা মেরেছে। সেই বোমার বারুদে ঝলসে গিয়েছে সেই কাঠমোল্লাদের বিকৃত চিন্তা, যারা রাস্তায় মিছিল করে মেয়েদের খেলা বন্ধ করার জন্য। যাদের নিদারুণ ফতোয়ায় বন্দি নারী উন্নয়ননীতি। ঝলসে গিয়েছে সেসব সমাজপতির অবয়ব, যারা বাইরে নারী উন্নয়নের হাওয়াই মিঠাই জনতাকে গেলাতে পারলেও ভেতরে ভেতরে তাদের কাছে নারীরা স্রেফ একটি পণ্য। নারীদের মানুষ হিসেবে ভাবতে, সম্মান দিতে যাদের বড়ই কার্পণ্য। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, সামাজিক বাধা আর বৈষম্যকে জয় করে মেয়েরা আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পুরুষতান্ত্রিকতা ও ধর্মতান্ত্রিকতার অন্ধত্বকে ছিন্ন করে সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙ্গিয়ে এই একেকজন যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন আজকের বাংলাদেশ। কারণ এখনো মেয়েদের খেলতে পারা বিশেষ করে একদম প্রান্তিক পর্যায়ের জন্য এক বড় প্রতিবন্ধকতা। ছেলেরা যেখানে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে সেখানে একজন মেয়েকে নিতে হয় পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত চ্যালেঞ্জ।

ওরা ১১ জন, বাংলাদেশের নানা প্রান্তের তারা শতদল। ফুলগুলোর নাম ভারী চমৎকার সানজিদা-সাবিনা-কৃষ্ণা- নীলা, রুপনা-ঋতুপর্ণা-আঁখি-মারিয়া-শামসুন্নাহার। পাহাড়, উপকূল, সমতল, অরণ্য জনপদের প্রতিনিধি তারা। নানা ধর্ম, বর্ণ আর জনপদের সমন্বয়ে তাদের এই ঐক্যতান এক মনিহার, যা বাংলাদেশের গলায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অথচ তাদের কারো হেলে পড়া ঘর ঝুপড়ি ঘর, কারো মা সামাজিক গঞ্জনা সইতে না পেরে খেলার বলটাই কেটে দিয়েছে, পরিবারের ওপরে ঝুলেছে, নাতনি ফুটবল খেলে বলে দোজখে যাওয়ার কারো ফতোয়া, মাথার ওপর নেই বাবার ছায়া, কাউকে আবার বিক্রি করতে হয়েছে বোনের অলংকার। জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজ তারা বয়সের চেয়েও অনেক বেশি পরিণত। দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কাছে হার না মানা এই জয়িতারা প্রচলিত সামাজিক প্রথা, যুক্তিহীন চিন্তা, সংস্কারের বিরুদ্ধে দিয়েছে এক মস্ত চপেটাঘাত। তারা খেলোয়াড়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খেলোয়াড়। তারা স্বর্ণাক্ষরে লেখা জ্বল জ্বলে ইতিহাস। যে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের রক্ত গঙ্গায় ভাসতে হয়েছে, সখিনা বিবিদের ঘর ভেঙেছে, সম্ভ্রম লুট হয়েছে, মুছে গিয়েছে হরিদাসীর কপালের সিঁদুর, তারা সেই স্বাধীনতা। সেই আসাদের শার্টের মতো উড্ডীন প্রিয় লাল সবুজ পতাকা।

অথচ এই তারাই রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার মতো সেই অবহেলা, সেই নতমুখের মতো ছিল। প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো ছিল নিমজ্জিত। কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না আমাদের, তাকানোর সময় কোথায়? কিন্তু তারাই তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেশকে তাদের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর এক ভীষণ কার্য সমাধা করেছে। এই জয় শুধু খেলার জয় নয় এই জয় সত্যিকারের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিনবদলের সূচনা। সাধারণ মানুষ এই যোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সফঙ্গ তাদের ভ্যানগার্ড হয়ে কদম কদম এগিয়ে একাত্মা প্রকাশ করেছে। এই ট্রফি প্যারেড মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসা, আবেগ আর উল্লাসের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ফুটবলার টিমের ডিফেন্ডার আঁখি কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, তারা তাদের পরিবারের শেষ সম্বল, তারা শুধু তাদের পরিবারের শেষ সম্বল নয়, তারা বাংলাদেশেরও সম্বল, রত্নআকর। অনেক কাঠখড় পোড়ানো এই আঁখিরাই লড়াকু বাংলার সম্বল। যাদের কারণে আমাদের চোখ উসকানি পায় দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখার। নতুন থেকে নতুন ইতিহাস গড়ার স্পর্ধা করার। আজ তাদের নিয়ে নানা সমাগম, হইচই, নানা আয়োজন, কোলাহল এবং কলরব। অনেক আশ্বাস, অনেক বন্দনা, তবে জোয়ারে হয়তো গা ভাসাবেন না আমাদের জয়িতারা। অনেক হাততালি, প্রশংসা, বিকিকিনি আবার ক্ষেত্রবিশেষে অতি নাটুকেপনাও আছে। তবে প্রকৃত যোদ্ধারা এই সবকিছুকে ছাপিয়ে নিশ্চয়ই অভীষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকবেন। একলব্যের মতো নিচল তাদের প্রত্যয়। ফেলে আসা বাস্তবতাকে মাথায় নিয়েই শতরঞ্জির ছক

কষবেন তারা নতুন আঙ্গিকে। বিজয়যাত্রার যে শুভ নবসূচনা হয়েছে তাদের হাত ধরে তা অব্যাহত থাকবে- এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

সাফ চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় নীলুফার ইয়াসমিন নীলার মা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে যেখানে আছে সেখানে শুধু আমার মেয়ে না আরো অনেক মেয়ে আছে সবাই আমার মেয়ে। সবাই আমার মেয়ের বয়সি। আমি আরো দোয়া করি ওরা যেন এগিয়ে যায়, বাংলাদেশকে আরো কিছু দিতে পারে সেই আশাই করি।’ আমাদেরও আশা ঠিক তাই। বাংলার মেয়েরা এগিয়ে যাবে শত বাধা উপেক্ষা করে নিজেদের গুণে সমৃদ্ধ করবে দেশ। বৈষম্যহীন সুযোগপ্রাপ্তি ও সঠিক পরিচর্যায় তারা হয়ে উঠবে দেশের সম্পদ। যে সমতাভিত্তিক

সমাজ আমরা বির্নিমাণ করতে চাই, সেই সমাজের তারা হবেন আলোকবর্তিকা।

তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে। দেবী দুর্গা তথা মাতৃশক্তির বোধন সম্পন্ন হয়েছে, যার পরিচিতি আমাদের কাছে মহালয়া নামে। বোধন হোক মানবতার, বোধন হোক শুভ শক্তির, বোধন হোক নারী শক্তির। চিন্তা, বোধ, বুদ্ধিতে যে দানবীয়তা যে আসুরিকতা তা নিপাত যাক। অসুর থাকবে কতক্ষণ অসুর যাবে বির্সজন। মাতৃপক্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভারর্সিটি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close