শামীম আহমেদ

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বিশ্ব পর্যটন দিবস

বাংলার প্রথম ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস

২০০৭ সালের কোনো এক বিকালে মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম। সেই দিন খেলা না হওয়ার কারণে আমরা কয়েকজন বন্ধু সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। সেই দিন আমরা ২০ কিলোমিটার রাইড করে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তার কিছুদিন পরে নবীগঞ্জ গণপাঠাগারে পেলাম সেজান মাহমুদের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০ অভিযাত্রী বইটি। এ বইটিতে মার্কোপোল, ইবনে বতুতা, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ভাস্কো ডা গামা, ডেভিট লিভিংস্টোন, রবার্ট এডউইন পিয়েরি, রবার্ট ফ্যালকন স্কট, তেনজিং- হিলারি, থর হেয়ারডাল ও রামনাথ বিশ্বাস। শেষ নামটি পড়ে বইটি পড়ার আগ্রহ দিগুণ হয়ে গেল। সেজান মাহমুদের ভাষায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০ অভিযাত্রীর মধ্যে রামনাথ বিশ্বাস কি শুধুই একজন বাঙালি হিসেবে স্থান পাওয়ার যোগ্য? না, সেটা ঠিক নয়। রামনাথ বিশ্বাসের জীবন ও কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর তাকে নিঃসন্দেহে একজন বিশ্বমানের ভূ-পর্যটক কিংবা অভিযাত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সে বইটি পড়া শেষে বাংলার প্রথম ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের রীতিমতো ভক্ত হয়ে গেলাম। যখন জানলাম আমাদের পাশের উপজেলায় তার বাড়ি তখন আমাদের নায়কের বাড়ি দর্শনে বের হয়ে পড়ি আমি ও তারেক। বানিয়াচং-এ গিয়ে আবিষ্কার করলাম রামনাথ নামে কারো সঙ্গে সাধারণ জনতার পরিচয় নেই। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন রামনাথের বাড়ি খুঁজে পেলাম আমরা তখন দখলদার ওয়াহিদ মিয়ার সাঙ্গপাঙ্গের মার থেকে কোনো রকম বেঁচে ফিরেছিলাম সেদিন। আমরা দুজন সেদিন বাড়ি উদ্ধার বা তা নিয়ে কোনো কথা বলতে যাইনি। স্রেফ পর্যটক হিসেবে ঘুরতে গিয়েছিলাম, তারপরও দখলদার ওয়াহিদ মিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাইনি। গত ১১ সেপ্টেম্বর রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিডিনিউজ ২৪-এর স্পেশাল অ্যাসাইমেন্ট এডিটর রাজিব নূরসহ চার সাংবাদিক বন্ধু আক্রান্ত হয়েছেন। শোনা যায় এ রকম ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটে রামনাথের বাড়িকে কেন্দ্র করে।

রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায়। বাবা বিরজানাথ বিশ্বাস আর মা গুণময়ী দেবীর দুই সন্তাানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই কৃপানাথ বিশ্বাস এলাকার নামকরা চিকিৎসক ছিলেন। শৈশবেই মা-বাবাকে হারান তিনি। এরপর বড় ভাইয়ের সংসারেই বেড়ে ওঠেন রামনাথ। ভর্তি হন বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবার মৃত্যু হওয়ায় অষ্টম শ্রেণির পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। এরই মধ্যে রাজনীতিতে যোগ দেন। অনুশীলন সমিতির সুশীল সেনের শাখায় সক্রিয় ছিলেন। পেশাগত জীবন শুরু করেন হবিগঞ্জের জাতীয় ভা-ার সমিতির ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে। সেখানেই তিনি সাইকেল চালনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। তারপর অন্য একটি কাজে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তার বিপ্লবী কার্যকলাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারালেন।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দেন বাঙালি পল্টনে। তবে অসুস্থতার কারণে বাঙালি পল্টনে বেশি দিন কাজ করা হয়নি তার। কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর ১৯১৮ সালে আবারও যোগ দেন সৈন্যবাহিনীতে। চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়ান বেশ কিছু জায়গা। এখান থেকেই তিনি পেয়ে যান ভ্রমণের অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণাই তাকে সাইকেলসমেত পৃথিবীর পথে নামিয়েছিল। সবমিলিয়ে নয় বছরের মতো ভ্রমণ করেছেন তিনি। পাড়ি দিয়েছেন প্রায় দেড় লাখ কিলোমিটার পথ। দেখেছেন চল্লিশটির অধিক দেশ।

১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিটে প্রবাসী বাঙালি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের উপচে পড়া ভিড়। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। কারণ রামানাথ বের হচ্ছে বিশ্বজয়ে। যাত্রায় সম্বল বলতে একটি বাইসাইকেল, দুটো চাদর, এক জোড়া চটি আর সাইকেল মেরামতের সরঞ্জামে ভর্তি একটি বাক্স। সমবেত জনতার সেই বিস্ময় গায়ে মেখে সব সংশয়, সব বাধা উপেক্ষা করে সাইকেলে প্যাডেল মারলেন রামনাথ বিশ্বাস। জনতার আশীর্বাদ নিয়ে পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়লেন ৩৫ বছর বয়সি যুবক রামনাথ বিশ্বাস। তার ভ্রমণে প্রথম যান মালয়েশিয়া। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে চীনে। এ সময় তার সঙ্গে চীনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা মাং সে তুং-এর দেখা হয়েছিল। রামনাথকে তখন কমরেড মাও প্রশ্ন করেিেছলেন, ‘তুমি কার ইচ্ছায় পৃথিবী ঘুরছো? রামনাথ জবাব দিয়েছিলেন, ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায়’। মাও তাকে বললেন, ‘না, তুমি নিজের ইচ্ছায়, নিজের হিম্মতে ঘুরছো। তুমি যদি পঙ্গু হতে, তাহলে কী ঈশ্বর তোমাকে এভাবে সাইকেলে করে ঘোরাতে পারত?’ মাং সে তুং- এর এ কথা শোনার পর রামনাথের ধ্যানধারণা পাল্টে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। চীন ভ্রমণ শেষে কোরিয়া হয়ে জাপানে যখন পা রাখেন এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে একটি বছর। সেখান থেকে পাড়ি জমান ফিলিপাইন। ঘুরে দেখেন ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ। তার পর ফিরে আসেন সিঙ্গাপুরে। এখানে মাস দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে। সিঙ্গাপুর থেকে রেলগাড়িতে করে পেনাং (মালয়েশিয়া)। সেখান থেকে জাহাজে মিয়ানমার। ছয় মাস মিয়ানমার ঘুরে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর, শিলং ঘুরে জন্মভূমি সিলেট ফেরেন। সিলেটে এসে এক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পান। একটু সুস্থ হয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে কলকাতায় যান। মাস ছয়েক কলকাতায় কাটান। ১৯৩৪ সালের জুলাইয়ে আবার বের হন।

এবার গন্তব্য উত্তর ভারত। সমগ্র উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষে আফগানিস্তান পৌঁছান। সেখান থেকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ভ্রমণ শেষে লেবানন হয়ে তুরস্ক যান। তুরস্ক থেকে ইউরোপের বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ভ্রমণ শেষে জাহাজে করে আবার কলকাতা ফেরেন। কলকাতায় ফিরে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লেখা আকারে প্রকাশ শুরু করেন। পরে ১৯৩৮ সালে রামানাথ ফের বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। এবার গন্তব্য আফ্রিকা। প্রথমে কলকাতা থেকে মুম্বাই যান। এরপর জাহাজে করে কেনিয়া পৌঁছান। পরে উগান্ডা, তানজানিয়া, জানজিবার, মালাউই, জিম্বাবুয়ে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যান। আফ্রিকা ভ্রমণ শেষে রামানাথ জাহাজে করে কানাডায় চলে আসেন। তবে কানাডা সরকার তাকে ভালো ভাবে গ্রহণ করেনি। বরং বন্দি করে ভারকোডার জেলে পাঠিয়ে দিল। সেখানে ২৯ দিন আটকে রেখে জাহাজে তুলে দিয়ে তাকে জাপান পাঠিয়ে দেয়। রামনাথ এ সম্পর্কে বলেন, ‘পৃথিবীর নাগরিক হিসাবে এ বিশ্ব ভ্রমণ করা আমার জন্মগত অধিকার’।

রামানাথ শুধু ভূ-পর্যটক ছিলেন না, ছিলেন একজন লেখকও। ভ্রমণ নিয়ে ৪০ এর অধিক বই লেখেছেন তিনি। তার শেষ জীবন কলকাতাতেই কেটেছে। ১৯৫৫ সালের ১৯ নভেম্বর সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বজয়ী বাঙালি ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস।

চীন ভ্রমণের সময় একটা হোটেলে ঢুকতে যাচ্ছেন রামনাথ। দেখলেন, জাপানি একজন চর চীনা যুবককে চাবুক দিয়ে বেদম প্রহার করছে। সহ্য হলো না রামনাথের সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ালেন। এ সময় জাপানি চর পাল্টা রামনাথকে চাবুক মারতে উদ্যত হলে তখন তিনি সেই চাবুক কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দিলেন বেশ কয়েক ঘা। অন্যায় সে যে-ই করুক, সহ্য করতে পারতেন না রামনাথ। আর তার বাড়িই দখল করে বসবাস করছে ওয়াহিদ মিয়া নামের প্রভাবশালীরা। বলা হয়ে থাকে, ‘গুণীজনদের সম্মান দেখালে, জাতিকেই সম্মান দেখানো হয়। তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলে অন্যরাও ভালো কাজ করতে উৎসাহবোধ করে।’ এ ভাবনা থেকে রামনাথের বাড়ি উদ্ধার করে সেখানে ভ্রমণ বিষয়ক পাঠাগার ও জাদুঘর করার দাবি করছি। লেখাটি শেষ করতে চাই, বিডিনিউজ ২৪ এর স্পেশাল অ্যাসাইমেন্ট এডিটর রাজিব নূর বলেছেন, রামনাথ বিশ্বাস চীন থেকে ফিরে বানিয়াচংয়ে এসেছিলেন। তখন কমলারানীর সাগরদিঘির পাড়ের মাঠে তার সম্মানে একটা জমায়েত ডাকা হয়েছিল। ওই জমায়েতে রামনাথ বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বাইন্নাচুং আমার দুইন্যাই।’ “মানে বানিয়াচং আমার পৃথিবী”। আমরা রামনাথের ‘দুইন্যাই’ পুনরুদ্ধার করতে চাই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close