আকিজ মাহমুদ

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মুক্তমত

ক্রীড়াক্ষেত্রে হারিকেন দ্যুতি

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যাতে আমরা অনেক বড় দেশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশটি ক্রীড়ামোদী মানুষে ভরপুর। বিশ্ব নন্দিত ক্রীড়াবিদের জন্ম এ ভূমিতে না হলেও খেলাধুলা নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের আবেগ পাহাড়সম। বৈশ্বিক বিভিন্ন ক্রীড়া আয়োজনে তা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। আমাদের জনসংখ্যার এই ক্রীড়াপ্রেমিকতা আমাদের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনারই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা বড় রূঢ়। ক্রীড়া জগতে আমাদের পদচারণার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। সময়ে সময়ে যা একটু আশা জাগানিয়া ছিল তাও মলিনতায় ভুলে যাওয়ার দরুন। মাঝে মাঝে ছোট ছোট কিছু সফলতা বাংলার বুকে দমকা হাওয়া বয়ে দিলেও পরক্ষণেই নিতে হয় দীর্ঘশ্বাস। ক্রীড়াক্ষেত্রে অধারাবাহিক সফলতার আলো যেন হারিকেন দ্যুতির মতো। নিভু নিভু বাতিতে চলছে যার যাত্রাপথ।

প্রচলিত অনেকগুলো খেলাই এখন আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ফুটবলের জনপ্রিয়তা এখন পূর্বপুরুষদের কাছে শুনলে আমাদের কাছে রূপকথার মতোই মনে হয়। দেশের ফুটবলটা চলছে ঠিক কিন্তু নেই সেই বর্ণিল উন্মাদনা। ফুটবলের জনপ্রিয়তা যে কমেছে তা কিন্তু নয়, বৈশ্বিক ফুটবল যেমন এগিয়েছে তেমনি এর জনপ্রিয়তাও আমাদের দেশে কয়েকগুণ বেড়েছে। আফসোসটা কেবল দেশীয় ফুটবলকে ঘিরে।

নিকট অতীতেও অন্ধকারে চলতে হারিকেনের জুরি ছিল না, দেশের ফুটবলটাও যেন তেমনই। একসময় ক্রীড়ামোদী মানুষের কাছে ফুটবল ছিল জনপ্রিয়তায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রীড়াক্ষেত্র। আধুনিক বিদ্যুতায়নের যুগে হারিকেন যেমন তার আবদার হারিয়েছে তেমনি দেশের ফুটবলটাও যৌবনসমেত হতাশায় ডুব দিয়েছে। জনপ্রিয়তার জায়গায় চলে এসেছে ক্রিকেট। অথচ সালাউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, কাজী নাবিলদের হাত ধরে ফুটবলের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নই বুনেছিল দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। ১৯৭২ সালে একফালি স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জন বলতে ফিফার সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং ছেলে ও মেয়ে দলের একটা সাফ ট্রফি জেতার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্রীড়ার এই ক্ষেত্রটিতে এগিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা ছিল। নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতায় আবদ্ধ ফুটবল ফেডারেশন যেন বোতলবন্দি অবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্প্রতি মেয়েদের সাফ ট্রফি জিতা তাই বাড়তি প্রত্যাশায় উৎসাহিত করে না, ফুটবলের বাস্তবিক বিশৃঙ্খলা সে আশার সলতে নিভিয়ে দেয়। দেশের ফুটবল যখন খেই হারিয়েছে, ক্রিকেট তখন দ্যুতিময় হয়ে ধরা দিয়েছে দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের মাঝে। এই আলোর মধ্যমণি সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা। তাদের নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। অথচ এখানেও বৈশ্বিক কোনো ট্রফি না জেতার আক্ষেপ রয়ে গেছে। ২০০০ সালে আইসিসির সদস্য পদ প্রাপ্তির পর এই খেলায় বড় সফলতা বলতে রয়েছে বয়সভিত্তিক দলের একটি বিশ্বকাপ অর্জন। যদিও খেলাটিকে ঘিরে মানুষ স্বপ্ন বুনছে। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। যারা ক্রীড়াঙ্গনের খোঁজখবর রাখেন তারা ক্রিকেটাঙ্গনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অদূরদর্শিতা দেখে ব্যথিত হন। ক্রীড়া জগতে দেশের সবচেয়ে ধনি সংগঠনের পরিকল্পনাহীনতা ফুটবলের অতীত জনপ্রিয়তাকেই মনে করিয়ে দেয়। ঘরোয়া মানহীন ক্রিকেট, ক্রিকেট উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে বোর্ড কর্তারাও ভালো জানেন। সমৃদ্ধ তহবিল থাকলেও ক্রিকেটটা এখন অনেক বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক, নেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যমান উদ্যোগ।

ক্রিকেট এবং ফুটবলের যখন এই অবস্থা তখন নিভু আলোয় জ্বলছে হকি, ভলিবল, কাবাডিও। এখানেও দেশের বড় কোনো প্রাপ্তি নেই। অথচ এই তিনটি খেলা দেখভাল করতেও রয়েছে পৃথক পৃথক সংগঠন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনটি খেলার ফেডারেশন এখনো নেতৃত্বের ক্যারিশমা দেখিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে দেশের জন্য বড় সফলতা আনতে পারেনি। উপরন্তু হকি ফেডারেশনের নির্বাচন নিয়ে হর্তাকর্তাদের মধ্যে যতটা উন্মাদনা চোখে পড়ে, খেলার মান উন্নয়নে ফেডারেশনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপের দেখা মেলে না। হাডুডু বাংলাদেশের জাতীয় খেলা, কাবাডি খেলার সঙ্গে এ খেলার খুব বেশি পার্থক্য নেই। গ্রামাঞ্চলে হাডুডু খেলা এখনো জনপ্রিয়। অথচ সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলাটিই হারিয়ে যেতেই বসেছে।

দেশে সব খেলার জন্য সংগঠন থাকলেও খেলার মান উন্নয়নে তা কতটুকু কাজে লাগছে সেই প্রশ্ন করার সময় বোধহয় এসে গেছে। কারণ বৈশ্বিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, অলিম্পিক গেমস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্বর্ণ পদকের সংখ্যা মাত্র তিনটি। ক্রীড়াক্ষেত্রে সফলতার ওপর হয়তো দেশের সার্বিক অবস্থা নির্ভর করে না। তবে আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়াক্ষেত্র অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখতে সক্ষম তা ভুলে গেলে চলবে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার নিয়ামকও হতে পারে এই ক্রীড়াক্ষেত্র।

ক্রীড়া ক্ষেত্রকে অবহেলা করে সুষ্ঠু প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভপর নয়। আমরা জানি একটি দেশ কেবল মেধার ভিত্তিতে এগোয় না। শারীরিক ও মানসিক সবলতাও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। তবে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে, জনসংখ্যার তুলনায় দেশে ক্রীড়া চর্চার পরিসর সীমিত হয়ে গেছে। মাঠ সংকটের কারণে তরুণরা ক্রীড়াবিমুখ হয়ে পড়ছে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বহুবিধ। তরুণদের বিপথগামী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণও এটি।

তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে ক্রীড়াক্ষেত্রকে সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। ক্রীড়া শিক্ষায় নিয়োজিত দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান (১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) বিকেএসপির পরিধি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া, প্রশিক্ষণের গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা নেওয়া এবং এর আধুনিকায়নে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে জবাবদিহির আওয়ায় আনা সময়ের দাবি। ক্রীড়াক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের সচ্ছতা নিশ্চিত করতেই হবে।

একইসঙ্গে বিদেশি ক্রীড়া উন্মোদনায় হারিয়ে যাওয়া দেশীয় খেলাগুলোর দিকে নজর ফেরাতে হবে। হাডুডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়া বান্ধা, লাঠিখেলা, মার্বেল খেলা, নোনতা কুস্তি বা বলী খেলা, লুকোচুরি বা কানামাছি, এক্কাদোক্কা, নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, বউছি, ডাংগুলি, সাঁতার ইত্যাদি দেশীয় খেলার ব্র্যান্ডিং করা বা বিশ্বায়নের ভূমিকা আমাদেরই নিতে হবে।

ক্রীড়াপাগল এই জাতির ক্রীড়া প্রতিভার ঘাটতি থাকবে তা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না বরং এই প্রতিভাগুলোকে খুঁজে বের করতে কাজ করতে হবে সংগঠনগুলোকে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে হারিকেন দ্যুতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ক্রীড়া পাগল জাতির অর্জনের খাতায় কচ্ছপ গতির সফলতার অঙ্ক সত্যিকার অর্থেই হতাশাজনক।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close