নূর আহমাদ

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ইসলাম

মজুদদারি : অভিশাপ বা গুনাহের কাজ

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। কথা ছিল আমাদের আচার-আচরণ দেখে বিশ্বের মানুষ ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হবে। কোরআন ও রাসুলের (সা.) সুন্নাহ বাস্তবায়নের দিক থেকে আমরা হব অগ্রগামী। আফসোস! কোরআন পড়তেই জানি না আমরা। সুন্নাহ কী তাও বুঝি না। আজান হলে দৌড়ে মসজিদে যাই, রমজান এলে সকাল থেকে সন্ধ্যা না খেয়ে কাটিয়ে দিই, পয়সা হলে কাবায় ঘুরে আসি-

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘কিছু মানুষ দাবি করে, আমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী। কিন্তু ওরা আদৌ বিশ্বাসী নয়। ওরা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ঠকাতে চায়। আসলে ওরা নিজেদেরই ঠকাচ্ছে, যদিও ওরা তা বোঝে না’- (সুরা বাকারাহ, আয়াত ৮-৯)। মুসলমান হতে হয় আচরণে, লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্যে। আফসোস! আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, মানুষের রক্তচোষাই তাদের একমাত্র টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে দাম বাড়লে একটি কী দুটো পণ্যের দাম বাড়ত। এখন সব পণ্যের দাম হুহু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট।

হায়! করোনাকালে দেখেছি, কত বড় বড় ধনকুবের খালি হাতে বিনা চিকিৎসায় দুনিয়া থেকে চলে গেলেন! আফসোস, চোখের সামনে এমন তাজা উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের মজুদদার বন্ধুরা দেদার মজুদদারি করে যাচ্ছেন। কী মহামারি, কী বিপদাপদ, কী রমজান, কী হজ- কোনো একটা দুর্যোগ বা প্রয়োজনের আভাস পেলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। মানুষের বিপদ পুঁজি করে মুনাফার স্বপ্ন দেখেন তারা। রমজান উপলক্ষে ঘৃণ্য মজুদদারি এ দেশের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। শত বলে-কয়েও মজুদদারি রোখা যাচ্ছে না। আসলে ব্যক্তির ভেতর যদি খোদাভীতি না জাগানো যায়, তাহলে আইন করে কখনো দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। তাইতো রাসুল (সা.) আইন প্রণয়নের আগে মানুষের ভেতর তাকওয়া জাগিয়ে তুলেছিলেন।

দাম বাড়ানোর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জমা রাখাকে ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইহতিকার বা মজুদদারি’ বলা হয়। অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা লাভের আশায় মজুদদারি করা অভিশাপ বা গুনাহের কাজ। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ‘সর্বসাধারণের কষ্ট ও ক্ষতি হয় এমনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আটকিয়ে রাখাই হলো মজুদদারি বা ইহতিকার। মজুদদারি গুনাহের কাজ হওয়ার কারণ হলো- এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণœ হয়, দৈনন্দিন জীবনের খাবারের চাহিদা মেটাতে মানুষ হিমশিম খায়, অর্থনৈতিক হয়রানির শিকার হয় এবং সব শ্রেণির মানুষ খাদ্য কষ্টে ভোগে। এজন্য ইসলামি শরিয়ত মজুদদারিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে’- (শরহে হেদায়া)।

প্রিয়নবী (সা.) মজুদদারকে গুনাহগার, অভিশপ্ত এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক হাদিসে মজুদদারকে গুনাহগার আখ্যায়িত করে হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী’- (বায়হাকি ও মিশকাত)। অন্য হাদিসে মজুদদারকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘অধিক মুনাফার লোভে মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট’- (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি ও মিশকাত)। মজুদদার ব্যক্তি সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, ‘মজুদদার ব্যক্তি খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের মূল্য কমে যায়, তাহলে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি মূল্য বেড়ে যায়, তবে তারা আনন্দিত হয়’। অন্যায়ভাবে মানুষকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে সামাজিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে মজুদ করা যেমন গুনাহের কাজ, তেমনি এর ফলে আল্লাহতায়ালা দুনিয়ায় মহামারির মতো ভয়ংকর আজাব দিয়েও শাস্তি দেন। হাদিসে এসেছে, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে অর্থাৎ মজুদদারি করে, তবে আল্লাহতায়ালা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন’- (মিশকাত)।

হাদিস ও সিরাতগ্রন্থ থেকে জানা যায়, মজুদদারি রোধে রাসুল (সা.) বাজার মনিটরিং করতেন। শুধু তাই নয়, সময়ে সময়ে ব্যবসায়ী সমাজের উদ্দেশ্যে উৎসাহবোধক এবং ঠকবাজ ব্যবসায়ীদের নিন্দা করে নসিহত করতেন। দেশের আলেম সমাজেরও উচিত এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করা। আলেমরা দুই ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রথমত, তারা ব্যাপকভাবে সৎ ব্যবসায়ীর প্রশংসা এবং ঠকবাজ ব্যবসায়ীর নিন্দা সংক্রান্ত কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করবেন। জুমার খুতবা থেকে শুরু করে ওয়াজের ময়দান সর্বত্রই ইসলামের বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষকে জানাবেন এবং সতর্ক করবেন। এভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি একদল আলেম নিজেরা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, রাসুল (সা.), চার খলিফা, চার ইমামসহ সালফে সালেহিন প্রায় সবাই ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে ব্যবসার প্রবণতা নেই বললেই চলে। দেশের টপ বিজনেসম্যানদের মধ্যে কোনো আলেম আপনি পাবেন না। আজ যদি শীর্ষ দশ ব্যবসায়ীর মধ্যে আলেমরা সংখ্যাগুরু হতেন, তাহলে মুনাফাখোররা রোজার মাসে বা প্রয়োজনের সময় কারসাজি করে মানুষকে কষ্ট দিতে পারত না। আলেমদের সততার কাছে ব্যবসার জাহেলি সিন্ডিকেট ভেসে যেত। আফসোস! আমরা তা করতে পারিনি। সময়ের দাবি হলো, বিষয়টি নিয়ে প্রবীণ আলেমরা ভাববেন এবং তরুণ আলেমরা ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

হে আমার মজুদদার ভাই! আল্লাহকে বেজারে করে, আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দিয়ে, মানুষের অভিশাপ কামিয়ে যে সম্পদের পাহাড় আপনি গড়ে তুলছেন, একটু ভাবুন কবরে এ সম্পদ কী কাজে আসবে? যাদের জন্য ইমান আমল বিকিয়ে দিয়ে আজাব পকেটে পুড়ছেন, তারা কি আপনার আজাবের ভাগিদার হবে? সেই যে কবে বাবা-মাকে কবরে রেখে এসেছেন, আর কি কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন? দুচোখের পানি ছেড়ে খোদার কাছে বাবা-মার মুক্তির জন্য মোনাজাত করেছেন? আপনার সন্তানের প্রতি আপনার যেমন মমতা, আপনার বাবা-মাও তো আপনাকে ঠিক তেমনই ভালোবাসতেন। আজ আপনি আপনার বাবা-মাকে ভুলে আছেন, কাল আপনার সন্তান আপনাকে ভুলে যাবে। এটাই হয়ে থাকে। তাই সন্তানকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজের আখেরাত শেষ করবেন না। মনে রাখবেন, কাফনের কিন্তু পকেট নেই। আল্লাহর কাছে তওবা করুন। মানুষে রিজিক নিয়ে কারসাজি থেকে ফিরে আসুন। আল্লাহ আমাদের বোঝার তওফিক দিন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close