মো. জিল্লুর রহমান

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

অপশাসনে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দায়

গত ৮ মে ২০২২ স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান ঘটেছে। দীর্ঘ ৭০ বছর তিনি যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন। রাজা ষষ্ঠ জজের মেয়ে হিসেবে ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়া তার রাজত্বই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘতম। ১৯৫৩ সালের ২ জুন মাত্র ২৬ বছর বয়সে রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক হয়। তিনি এমন সময় রানি হন যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হওয়ার পালা শুরু হয়েছে। ১৫৭৮ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় থেকে ইংল্যান্ডের আজকের ব্রিটেনের বাইরে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরুতে শুধু আমেরিকা মহাদেশে হলেও পরে তা বিস্তার লাভ করে এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। একপর্যায়ে বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে- যে কারণে বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায়নি।

মূলত যুক্তরাজ্য চালায় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা। এর পরও রাজপরিবার এখনো বহাল তবিয়তেই টিকে রয়েছে দেশটিতে। এখনো রানির নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কুইন্স গার্ড। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার নামেই যুক্তরাজ্যে জারি হয় রাষ্ট্রীয় সব আদেশ। ব্রিটিশ আইনের দৃষ্টিতে রানির অবস্থান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে তিনি অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন। তাকে দেওয়ানি ও ফৌজদারি তদন্তের অধীনে বিচার করা যাবে না, এমনকি কোনো অপরাধেই তাকে আটক করা যাবে না। এ ধরনের নানা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে ব্রিটিশ রাজপরিবার ও রানি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রানি প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী শাসক। ব্রিটেনে তখন নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা তখন রাজপরিবার বিশেষত রাজা বা রানির হাতে। অনেকটা তাদের কথাই ছিল আইন। ব্রিটেনে তখন পুঁজিবাদের সবে বিকাশ শুরু হয়েছে। পুঁজির বিকাশের জন্য প্রয়োজন নতুন নতুন উপনিবেশ। সামন্ত সমাজ কাঠামোর মধ্য থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, কোনোটাই সম্ভব নয়। এসবের জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদের বিকাশ। আর তা সম্ভব একমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্য দেশে উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়েই- ব্রিটিশ রাজপরিবার এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন সম্প্রসারিত হয় এবং শাসনের নামে শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন শুরু হয়, যা প্রায় ২০০ বছর স্থায়ী হয়।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শুরু হয়েছিল ১৭৬৯-৭০-এর দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে। এরপর পুরো শাসনকালে নিয়মিত দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানও হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে আর কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। ভারতবর্ষের জনগণ যত দিন না তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পেয়েছে, তত দিন ভারতবর্ষ দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পায়নি। ব্রিটিশ অপশাসনের এসব তথ্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ২০২১ সালের ৮ জুলাই প্রকাশিত তার স্মৃতিকথা ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড : আ মেমোয়ার’ বইতে বিশ্লেষণ করেছেন, যা তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

অমর্ত্য সেন লিখেছেন, পলাশীর যুদ্ধের খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘বাংলার অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ’ শুরু হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নবাবদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু রাজস্বই নয়, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ পায়। এর বাইরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নিয়মিত তারা কথিত উপঢৌকন পেতে থাকে। ভারতবর্ষ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল লিখেছেন, ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন গড়ে তোলা হয়, তখন বিশ্ব জিডিপিতে ব্রিটেনের অবদান ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। যখন ব্রিটিশরাজের শাসন চূড়ায় তখন চিত্র উল্টো। ভারত তখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী দেশ থেকে ‘দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে’ পরিণত হয়েছে। বাংলা থেকে লুট করা অর্থ ব্রিটেনে চলে যেত। এর সুবিধাভোগী ছিল ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃত্ব। পলাশী যুদ্ধের পর দেখা গেল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন।

তিনি আরো লিখেছেন, এই লুটেরা শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ভারতে ক্ল্যাসিক্যাল উপনিবেশবাদের পথ করে দিয়েছিল। তা হয়েছিল আইনের শাসন ও যুক্তিসংগত শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। কিন্তু প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাষ্ট্রক্ষমতার যে অপব্যবহার করেছিল, তাতে বাংলার অর্থনীতি ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে। মানচিত্রকর জন থর্নটন ১৭০৩ সালে তার আঁকা প্রখ্যাত মানচিত্রে এই অঞ্চলকে ‘ধনসম্পদে পরিপূর্ণ বাংলা রাজ্য’ বলে উল্লেখ করেন। অথচ সেই বাংলায় ১৭৬৯-৭০ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। ধারণা করা হয়, তখন বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোকের মৃত্যু হয়। এটি অতিরঞ্জন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সন্দেহ নেই যে তখন ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে, ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব ও মৃত্যু হয়। অথচ এর আগে দীর্ঘ সময় এ অঞ্চলে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি।

ঔপনিবেশিক শাসনের ২০০ বছর ছিল ব্যাপক অর্থনৈতিক স্থবিরতার কাল। প্রকৃত মাথাপিছু আয়ও বাড়েনি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরই এই নির্মম সত্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কল্যাণে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এটা সত্য যে ভারতীয় গণমাধ্যম এই চরিত্র পেয়েছিল ব্রিটিশ সিভিল সোসাইটির কাছ থেকেই। ব্রিটিশরাজের সময় সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সমালোচনা যাতে করতে না পারে, সেজন্য প্রায়ই ভারতীয় গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হতো। যেমনটি করা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময়। অন্যদিকে ব্রিটেনে খুব যত্নে লালন করা মুক্ত গণমাধ্যমের চর্চা স্বাধীন ভারতের সামনে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে হাজির করা হয়েছিল।

ব্রিটিশরা দাবি করে, ভারতবর্ষে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রেলওয়ে, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল অর্জন রয়েছে। কিন্তু তত্ত্ব আর বাস্তবতার তুলনা করলে দুদেশের ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, এক ক্রিকেট ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ফারাকটা ব্যাপক। ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো বা ভগ্নস্বাস্থ্যের প্রতিকারের বিষয়টি ব্রিটিশ শাসনের অর্জনের তালিকায় নেই। এই সাম্রাজ্যের যখন শেষ হয়, তখন ভারতে মানুষের গড় আয়ু ছিল অবাক করার মতো মাত্র ৩২ বছর। শুধু তাই নয়, এমনকি ভারতবর্ষের শিক্ষা খাতটিও ছিল অবহেলিত। উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার তার জনগণের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা অর্জনে ক্রমেই জোরালো অবস্থান নিচ্ছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশরাজের অধীনে ভারতে শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। ব্রিটিশ শাসনের যখন সমাপ্তি ঘটে, তখন দেখা যায় ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শিক্ষার হার মাত্র ১৫ শতাংশ।

অন্যদিকে, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বড় পরিসরের ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয় শুধু ঔপনিবেশিক শাসনকালেই; কেননা ব্রিটিশরাই এ অঞ্চলে শাসন শুরু করার পর এমন অনেক সমস্যাকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপে প্রচার করতে থাকে, এর আগে যেগুলো ছিল নিছকই সামাজিক। মূলত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভারতীয় সমাজে ধর্মই হলো মৌলিক বিভাজনের নেপথ্য-কারণ। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব ও বিবাদের দেয়াল গড়ে তোলাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নীতি : এই ‘বিভাজন ও শাসন’-নীতি তার চরম শিখরে পৌঁছায় ১৯৪৭ সালে, যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। দেশভাগের ফলে দশ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে, ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশান্তরী হয় এবং কয়েক বিলিয়ন রুপির সম্পদ ধ্বংস হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহামূল্যবান ১০৫ দশমিক ৬ ক্যারেটের কোহিনূর হীরার জন্মস্থান ভারতবর্ষে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতেই মিলেছিল এ হীরা। তারপর বহুবার হাতবদল হয়। ব্রিটিশরা ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব অধিকার করে। বিশ্বের সম্ভবত সবচেয়ে সুপরিচিত হীরক- কোহিনূর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৪৯ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে এই কোহিনুর হস্তান্তর করা হয়েছিল। সেই থেকে ব্রিটেনের শাসকদের মাথায় শোভা পেতে থাকে এ হীরা। তারও আগে ভারত এবং মধ্য এশিয়ার অন্য বেশ কয়েকজন শাসকের মাথায় এই কোহিনূর মুকুট শোভা পেয়েছে। পরে প্লাটিনামের মুকুটে বসানো রয়েছে কোহিনূর। ১৯৩৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জজের অভিষেকের সময় তৈরি করা হয়েছিল সেই মুকুট। পরেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা প্রথম এলিজাবেথ। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই মুকুটের অধিকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। টাওয়ার অব লন্ডনে রাখা থাকে সেই মুকুট। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর টুইটারে অনেক ভারতীয় মহামূল্যবান কোহিনূরটি ফেরত চাইছে।

ভারতবর্ষে মূলত ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালকে ব্রিটিশ শাসন বোঝায়। এই শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্রিটিশ রাজ বা রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়, যাকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতের সম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই শাসন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রদেশগুলোকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনের নামে শোষণের ফলে ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষে বড় আকারের বেশ কটি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষগুলোর প্রভাব খুবই গুরুতর ছিল, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। ব্রিটিশ এবং ভারতীয় অনেক সমালোচক এই দুর্ভিক্ষের দায়ভার চাপান উপনিবেশ শাসকদের ওপর। যেহেতু ব্রিটিশ রাজপরিবার একসময় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মালিক ও রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাভোগী ছিল, তাই অনেক বিশ্লেষকের মতে ভারতবর্ষের অপশাসনের দায়ভার তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close