মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মতামত

ভিশনারি নেতাই জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন

বিশ্বব্যাপী এখন নানা ধরনের সংকট চলছে। অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি সংকট, ভোজ্য তেলের সংকট, জলবায়ু সংকট, পূর্ব-পশ্চিমের সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার সংকট এবং করোনা সংকট তো যেতে যেতেও যাচ্ছে না। এতসব সংকটের গ্যাঁড়াটোপে সারা পৃথিবী এখন আটকে গেছে। তবে করোনা এবং জলবায়ু সংকট মানবসৃষ্ট নয়; বাকি সবই মানবসৃষ্ট অর্থাৎ বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে সংকটগুলো সবাইকে বেঁধে ফেলেছে। এমনকি পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেরা এ জালে এখন আটকে পড়েছে, যেহেতু তাদের শক্তি অর্থ-বিত্ত সম্পদ অঢেল, তাই তাদের কাছে এসব সংকট তেমন কোনো আতঙ্কের নয়। বরং সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের মতো রাষ্ট্রগুলোকে তারা ব্যবহার করবে। আমরা তো এমনিতেই এখন তাদের পাতানো নানা ফাঁদে আটকা পড়ে আছি, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু এমন ভয়াবহ চতুর্মুখী সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানোর জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। আবার রাষ্ট্র ও জনগণকে সঠিক পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়ার ভিশনারি-মিশনারি নেতার কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাসের এমন সংকটকালে নেতা ও জনগণের মধ্যে থাকতে হয় অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, একটির অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণটাই ভেস্তে যায়। সুতরাং সন্ধিক্ষণে জনগণ এবং নেতাকে এক হয়ে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে, এর কোনো ভিন্নতা চলবে না। আমরা এখন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও জলবায়ুর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যেভাবে পড়েছি সেটি অবশ্যই মোকাবিলা করার জন্য আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে, নেতৃত্বকে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে, তাহলেই আমরা এই বহুমুখী সমস্যা ও সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারব। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ না করার কারণ হচ্ছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অতীত অভিজ্ঞতা।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যখন অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা শুরু করেছিল, তখন তারা ভেবেছিল যে আমাদের মাটি তাদের দখলে থাকবে মানুষ মরে ছারখার হয়ে যাবে; তারা সে নীতিতেই অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে আমাদের ছিলেন একজন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীরা যাদের ওপর গোটা জাতির তখন আস্থা ছিল। তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলেই কেল্লাফতে, কিন্তু কেল্লাফতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, তার সহযোগী নেতারা তার নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করলেন এবং শেষ পর্যন্ত আমরা জয়লাভও করলাম। পাকিস্তানিরা বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণ করে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ইতিহাসের এত বড় অর্জন জনগণ ও নেতৃত্বের মেলবন্ধনে সম্ভব হয়েছে। নিজ হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করলেও সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন; ইতিহাসের এমন কঠিন অধ্যায় পার হওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। পৃথিবীর অনেক সরকার এবং রাজনৈতিক নেতা তখন বিশ্বাস করতে পারেননি যে বাংলাদেশ যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণেই আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় সব মূল নেতৃত্বকে হত্যা এবং জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়; জাতি নেতৃত্বশূন্য হয়। এর খেসারত গোটা জাতিকে দীর্ঘদিন দিয়ে আসতে হয়েছে। আমাদের যারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাদের কেউই ভিশনারি-মিশনারি নেতা ছিলেন না। ফলে প্রায় ৪০ বছর কেটে গেছে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া সেই স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থানে। আমাদের মধ্যপ্রাচ্যে মিসকিন দেশ বলা হতো, উন্নত দেশে বলা হতো বন্যা, দুর্ভিক্ষ এবং ভিখারির দেশ হিসেবে।

প্রতি বছর আমাদের অর্থমন্ত্রীরা প্যারিস কনসোর্টিয়ামে বিদেশিদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে ধরণা দিতেন, তা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি, হয়েছে কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তির ধনসম্পদ অর্জনের সুযোগ। তত দিনে বাংলাদেশ একটি লোডশেডিংয়ের দেশে পরিণত হয়, খাদ্য উৎপাদনে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ছিল না কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, বাংলাদেশ চলছিল গতানুগতিক ধারায়। কারণ যারা সরকার চালিয়েছিলেন তাদের কেউই বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেননি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা, অন্যসব সমস্যার জট পাকিয়ে বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত করে রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভিধা বাংলাদেশকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক মহলে কেবলই মøান হয়েছিল। কারণ একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে এর আর্থসামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের জন্য যেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উপস্থাপন জাতির সম্মুখে করা প্রয়োজন ছিল সে ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তত দিনেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার ধারে-কাছেও ছিল না। বরং যারা যোগ্যতা, মেধা ও দেশপ্রেমে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরাধিকার হতে চেয়েছিলেন তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে অনেককে হত্যাও করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড চার্জের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশে এমন একটি দুর্বিষহ রাজনৈতিক অধ্যায় ৭৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অতিক্রম করেছিল। তবে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনের প্রাক্কালে দিনবদলের সনদ, রূপকল্প ২০২১ যখন উপস্থাপন করেন তখন অনেকেই ভেবেছিলেন যে এসবই মিথ, বাস্তবে কোনো দিনই দেখা যাবে না। তবে পরিবর্তনে বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষ ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। তিনি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই একের পর এক রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেন তখন অনেকেই এর মর্মার্থ বুঝতে না পেরে হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন। আবার যখন তিনি দেশকে বিদ্যুতায়নের জন্য একের পর এক উদ্যোগ নিতে থাকেন, তখন অনেকেই লোডশেডিংমুক্ত দেশ হবে, এমনটা এক দুরাশার খোয়াব বলে পরিহাস করছিলেন।

যখন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার উদ্যোগ নিলেন তখন অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ওই ট্রাইব্যুনাল ট্রাইব্যুনালই থাকবে বিচার আর হবে না, যখন তিনি পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করবেন বলে ঘোষণা দিলেন তখন অনেকেই তা নিয়ে উপহাস করেছিলেন। আমরা বাঙালি এটা সত্য; তবে এই অবিশ্বাসের দায় বাঙালিকে কেন দিতে হবে? বাঙালি তো আসলে দীর্ঘদিন ভিশনারি নেতৃত্বের কাছ থেকে দূরে ছিল। অনেক মেকিই নেতৃত্বের আশ্বাস শুনে বারবার প্রতারিত হয়েছে। সে কারণেই মানুষ প্রায় ৪ দশকজুড়ে যাদের রাষ্ট্রপরিচালনায় দেখেছে তাদের কথা ও কাজে তেমন কোনো মিল পায়নি; শেখ হাসিনা অবশ্য ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে সরকারপ্রধান হিসেবে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার শুরু এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপন করলেও মানুষের মধ্যে মিথ্যা অপবাদের নানা প্রচার-প্রচারণায় অনেক কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালের পর যখন তিনি এত সব বড় পরিকল্পনা দিচ্ছিলেন। তখনো তার বিরোধী পক্ষ ক্ষমতা থেকে উৎখাত করাসহ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করা হয়; ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে রাজনীতিতে নামিয়ে, দেশে একটি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তিকে দাঁড় করানো হয়। এমন প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেও শেখ হাসিনা একজন ভিশনারি-মিশনারি নেতা হিসেবে পদ্ম সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সফল, খাদ্য উৎপাদন সয়ম্বর, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রিজার্ভ কয়েক গুণ বৃদ্ধি, জাতীয় বাজেট প্রতি বছর লাখের অঙ্ক ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ তত দিনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে। এরপরই জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করে। সারা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে তখন অভিনন্দিত করা হতে থাকে। এসব দৃঢ় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে। গত দুই বছর করোনা মহামারিতে অনেক শঙ্কায়-সংকটে কাটলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আমাদের সহজে তা পার করে নিতে সক্ষম হয়। করোনার শেষ হয়নি তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্তমান বিশ্বে যে অর্থনৈতিক অবরোধ ডেকে এনেছে তাতে আমাদের বেশ চাপে ফেলেছে। পৃথিবীর অন্যরাও দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদিতে এখন নাকাল অবস্থায় পড়েছে। আমাদের এখানেও আমদানিনির্ভর পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ী, পরিবহন চক্র, মধ্যস্বত্বভোগী, মজুদদার ইত্যাদি পকেট কাটার অপচেষ্টায় লিপ্ত। জ্বালানি তেল আমদানি কিছুটা কমিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় সরকার লোডশেডিং, পরিবহন ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। এই অবস্থায় জনজীবনে কিছুটা ভোগান্তি ও টানাটানি সৃষ্টি হয়েছে, তবে আশা করা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শেষে কিছু কিছু বিষয় উভয় দেশের সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চাকা আরো সচল হয়ে উঠবে, বিদ্যুৎ আরো বেশি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই সংকট অতিক্রম করার নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য শিগগিরই আরো কমে আসবে, জ্বালানি তেলের দাম নাগালের মধ্যে চলে আসবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় জলবায়ুর অতি উষ্ণায়নের ফলে এ বছর আমরা এখনো বর্ষাকাল দেখিনি, ফলে আমাদের ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ, গবাদি পশু পালন, ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থান নেমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের বিভ্রান্তি নয় বরং সঠিক কারণ জানার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যত্নশীল হতে হবে। আমরা টানা সাড়ে ১৩ বছর যার নেতৃত্বে এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পেরেছি তার নেতৃত্বেই বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অনেকটাই সম্ভব বলে আমাদের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেওয়ার যথেষ্ট বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। আমাদের এতসব কঠিন চ্যালেঞ্জ শুধু ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বের মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব। এজন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নেতৃত্বের সৎ পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। অন্যদের যার যার অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close