আবদুর রউফ
মুক্তমত
দায় ও দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহি
আবদুল মোমিন পেশায় একজন ড্রাইভার। ঢাকার উত্তরায় একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যভাবেই চলছিল তাদের সংসার। বড় ছেলে সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আর মেয়েটির বয়স দেড় বছর। একটি প্রাইভেট কার চালিয়ে প্রতি মাসে মোটামুটি যে টাকা ইনকাম হতো তাতে খুব ভালোভাবেই তাদের সংসার চলছিল। তবে সেই সুখের সংসারে নানা রকম টানাপড়েন দেখা দেয়, দেশে যেবার প্রথম সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হয়। তার পরও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ঢাকাতেই টিকে ছিল এই পরিবারটি। করোনা আয় কমে যাওয়ার ফলে বেশ কিছু টাকা ঋণ হয়ে গেছে। তবেই পরিবারটি স্বপ্ন দেখেছিল হয়তো করোনা-পরবর্তী সময়ে ইনকাম বৃদ্ধি পাবে। আবারও হয়তো তারা আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন পরিচালনা করবেন। দীর্ঘ সময় দরিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এই পরিবারটি ঢাকায় টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী দেশে নিত্যপণ্যের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।
মর্জিনা বেগম পেশায় একজন কাজের বুয়া। বয়স প্রায় ৫০-এর বেশি। স্বামী প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী। তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে ঢাকার একটি বস্তিতে বসবাস করেন। দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে একটি বাসায় ৯ হাজার টাকা বেতনে কাজ করে বেশ ভালোভাবেই দিন চলছিল। রুমভাড়া, অসুস্থ স্বামীর ওষুধ, ছোট ছেলের পড়াশোনা ও সংসারের যাবতীয় খরচ এই টাকা দিয়ে মোটামুটি চলে যেত। করোনার প্রকোপ বাড়লে সেই বাসার কাজটিও চলে যায়। সেই পুরো সময়টি ধারদেনা করে কোনো রকম টিকে ছিল পরিবারটি। করোনার প্রকোপ কমার পরপরই সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে দুটি বাসায় কাজ শুরু করেন। এই পরিবারটি মনে করেছিল করোনা-পরবর্তী সময়ে হয়তো জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিত্যপণ্যের দাম নাগালের ভেতরে চলে আসবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেট ও সরকারের বাজারে সমন্বয়ীনতার কারণে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি চলমান থাকল। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন এমন এক বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে অবতীর্ণ হলো যার দরুন গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল হয়ে গেল। তাই প্রতিদিনই বিশ্ববাজার ও দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে।
মর্জিনা বেগমের সংসার চালানো প্রায় দুষ্কর হয়ে উঠেছে। গ্রামের বাড়িতে ভিটেমাটি না থাকার কারণে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে গ্রামে পাড়ি জমাতে পারছে না। ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় ছেলে সুমন বাসের হেলপারের চাকরি নিয়েছে। মেজো মেয়ের বয়স মাত্র ১৫ বছর। সে বাড়িতেই অবস্থান করে অসুস্থ বাবার দেখাশোনা, ঘরের কাজ ও রান্নাবান্না করে। ছোট ছেলেটিকে একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করেছিল। বর্তমান বাস্তবতায় সেই ছেলেটিকে একটি চায়ের দোকানে কাজে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের গল্প এখন একই রকম। শহর ও গ্রামের মধ্যে সেই গল্পের কোনো পার্থক্য নেই। একদম হতদরিদ্র পরিবারগুলো মানুষের কাছে হাত পেতে হলেও, খেয়ে বা না খেয়ে, জীবনযাপন করছে। আর এদিকে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভালো থাকার অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই তাদের দেয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছে। বৈশ্বিক সমস্যার অজুহাত টেনে বেশ কয়েকবার নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশে বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জনজীবনকে একদম ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সব কলাকৌশল শিখে গেছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময় যুক্ত হয়েছে দেশের কয়েকটি ব্যাংক। এমনিতেই টাকার মান নিম্নগামী। ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সেই ডলারের অবৈধ মজুদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছিল এই ব্যাংকগুলো। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিষয়টি কতটা ভয়ংকর একবার চিন্তা করুন। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা শিখে গেছে। অবশ্য এর পেছনে রাষ্ট্রের দায়ভার অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে কারো কোনো কথাই জনগণ বিশ্বাস করছে না। সমন্বয়হীনতার ব্যাপক উদাহরণ মানুষের সামনে চলে এসেছে।
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সরকার সর্বশেষ ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি করেছে। দাম বেড়েছে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রলে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায়, কেরোসিন ১১৪ টাকায়, অকটেন ১৩৫ টাকায় ও প্রতি লিটার পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হবে। আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা করেছিল সরকার। তবে সে সময় অকটেন ও পেট্রলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। সে সময় বর্তমানের তুলনায় কম টাকা বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা আমাদের সবারই জানা। একদম হঠাৎ আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করবে তাই একটু চিন্তা করলেই অনুমান করা যায়। এরই মধ্যে পরিবহন সেক্টর, কৃষি উৎপাদন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছে। তবে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ার মতো। যে যার ইচ্ছামতো মূল্যবৃদ্ধি করছে। সাধারণ মানুষ একপ্রকার জিম্মি হয়ে অতিরিক্ত দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো বাংলাদেশে এখন প্রতিটি সমস্যা বৈশ্বিক বলে প্রচার করার প্রবণতা বাড়ছে। আমাদের দেশের কর্ত ব্যক্তিদের থেকে প্রতিনিয়তই শুনতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেই নাকি এমনটি হয়েছে। এ কথা বিশেষজ্ঞরা একদম অগ্রাহ্য করছেন না। তবে এটিও চরম সত্য কথা, প্রতিটি সমস্যা বৈশ্বিক সমস্যা নয়। বরং কিছু কিছু সমস্যা আমাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফল। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কোটি কোটি টাকা জমা পড়েছে। বেগমপাড়ায় আমাদের আমলা, এমপি-মন্ত্রীরা বাড়ি বানাচ্ছেন। নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসার পরও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
দায়, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি- তিনটিরই বাংলাদেশে বড় অভাব। যখনই কোনো কিছুর দাম বাড়ে সরকারের উচ্চমহল থেকে সর্বশেষ সেটিকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের জনগণের বিষয়ে কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একদম স্বাধীন হওয়ার কথা ছিল। অথচ সেবামূলক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই যেন দুর্নীতির আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জবাবদিহির অভাব এই পরিস্থিতিকে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে। কোনো সেক্টরেই কোনো জবাবদিহি ও সমন্বয় নেই। যে যার মতো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে উত্তরণে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিবিদদের। বিশেষ করে সরকারে থাকা রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি জনগণকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। সাধারণ মানুষের সব অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রনিয়ামক ভূমিকা পালন করবে- এমনটি প্রত্যাশা রইল।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"