রেজাউল করিম খোকন

  ১৭ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে অস্থির বাজার

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো নেই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধিও কম। রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্যঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের যে ঘাটতি, তাণ্ডও গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। এর প্রভাবে শুধু চলতি বছরেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে।

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সংকটে পড়েছে। ফলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হচ্ছে সরকারকে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। মধ্যবিত্তের নতুন লড়াই শুরু হলো। জ্বালানি তেলে ইতিহাসের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় অনেকটা হতভম্ব সবাই। আরেক দফা মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এটা প্রায় অবধারিত। এখন চাল, ডাল, তেল, লবণের পাশাপাশি যাতায়াত, পোশাক, খাতাণ্ডকলমসহ নানা ধরনের খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। আয় না বাড়লেও খাবার-দাবারসহ ভোগ কমিয়ে সংসারের বাজেট মেলাতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জীবনযাত্রার পদে পদে খরচ বাড়াবে। আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন, লাগামহীন খরচে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা লাখ লাখ পরিবারকে আবারও গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

জ্বালানি তেলের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তা বড়লোকের জন্য শুধু বিরক্তির ব্যাপার। কিন্তু গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের কাছে তা জীবিকার সংকট। এবারের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের বেশি কষ্ট হবে। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সব খাতেই খরচ বাড়বে। মানুষ বাজারে গিয়ে ঠিকই টের পাবে। কারণ, বাজারের জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য লুকিয়ে রাখা যাবে না। কম টাকায় যাতায়াতের জন্য বাসে চড়েন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ। সেই বাসভাড়াও বেড়ে যাচ্ছে। এতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্তের কষ্ট-ভোগান্তি বাড়বে। দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আবার গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ। অর্থনীতিতে আকস্মিক চাপ বা নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে এই দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা পরিবারগুলো আবার গরিব হয়ে যেতে পারে। জনশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। সেই হিসাবে, ৯ কোটির বেশি মানুষ এমন ঝুঁকির মধ্যে যেকোনো সময় পড়তে পারে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে পরিবহন খাতে। যাতায়াত ভাড়া বেড়ে যায়। বাড়ে পণ্য পরিবহন খরচ। এরই মধ্যে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রাজধানী ও আশপাশে আসে। সেখানেও ভাড়া বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে চাল, ডাল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বাজারে এসব পণ্যের দামও বাড়ছে। বাজার থেকে বেশি দামে নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। এখন আমনের মৌসুম চলছে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেল ব্যবহার করে জেনারেটরের মাধ্যমে পাম্প চালাতে হচ্ছে। এমনিতে ডিজেল ব্যবহার বেড়েছে। এখন বাড়তি দামে ডিজেল কিনতে হবে। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। শিগগিরই বাজারে এর প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ওই চালের চালান যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে যাবে, তখন বাড়তি ট্রাকভাড়াও গুনতে হবে। চালের মতো শাকসবজি, আলু, পেঁয়াজসহ অন্যান্য নিত্য ভোগ্যপণ্যের দামও একই হারে বাড়বে। কয়েক মাস ধরেই পোশাক-আশাক, তেল-সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, খাতাণ্ডকলম ইত্যাদি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়তির দিকে আছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে আরো উসকে দেবে। প্রথমেই পরিবহন খরচ বাড়বে।

এ ছাড়া পোশাক কারখানাসহ ছোট-বড় শিল্প-কারখানায় ডিজেলচালিত জেনারেটর চলে। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় জেনারেটরের ব্যবহার বাড়বে। এখন ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচও বাড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে দাম বাড়াবে প্রস্তুত পণ্যের। কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলছে। গত নভেম্বর মাসে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিই ছিল এর অন্যতম কারণ। দুই-তিন মাস ধরেই অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি হয়েছে লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি। এই ঘাটতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণসহায়তা চেয়েছে সরকার। ৪৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ পাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে আইএমএফ সব সময় জ্বালানি খাতে ভর্তুকি না দিয়ে দাম সমন্বয় করার তাগিদ দিয়ে আসছে। এর আগে এক দশক আগে বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) আওতায় ১০০ কোটি ডলার নিয়েছিল বাংলাদেশ। আইএমএফের শর্ত হিসেবে একাধিকবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়। মূল্যস্ফীতি ৮-৯ শতাংশে পৌঁছালেই ঝুঁকিতে থাকা মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে শুরু করে।

করোনার কারণে এমনিতেই মানুষের আয় তেমন বাড়েনি, বরং কারো আয় কমেছে। এমন অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির বড় উল্লম্ফন হবে। শুধু কেরোসিনের দাম বাড়ার ফলে গ্রামের মূল্যস্ফীতি দশমিক ৮ শতাংশ বাড়বে। মধ্যবিত্ত যারা, তারাই আয় হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। সুতরাং, মধ্যবিত্ত বিকাশের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি আরো এগিয়ে যাবে বলে যে প্রত্যাশা ছিল, তা অনেকটাই হোঁচট খাচ্ছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে গতানুগতিক নীতি বদলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের যে চ্যালেঞ্জ, সরকার তা কতটুকু নিতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। গত কয়েক মাসের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে ভোগান্তি বেড়েছে। অনেকে আশায় ছিলেন, বাজেটে তাদের ভোগান্তি কমাতে কোনো কিছু থাকবে। কিন্তু বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানোর তেমন উদ্যোগ নেই, বরং বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব তাদের বাড়তি চাপে ফেলেছে। এবার বিনিয়োগের সুযোগ আরো সীমিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চাপে পড়েছে। মধ্যবিত্তরা এখন ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার। এগুলো হলো বৈষম্যমূলক বাজেটীয় পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব আক্রমণে মধ্যবিত্তের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজার পরিস্থিতির কারণে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়েছে। সর্বশেষ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মধ্যবিত্ত ও গরিবরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১০-১৫ বছরে অর্থনীতিতে এমন চাপ আর দেখা যায়নি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close