সাহাদাৎ রানা

  ১৬ আগস্ট, ২০২২

মুক্তমত

লেভেলক্রসিং নয়, যেন মৃত্যুফাঁদ

আশঙ্কাজনক হারে দেশে বাড়ছে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা। সঙ্গে বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যাও। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে খৈয়াছড়া ঝরনা লেভেলক্রসিংয়ে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর এ নিয়ে কয়েক দিন আলোচনা হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য কর্তৃপক্ষের লোক-দেখানো কর্মকাণ্ড লক্ষ করা গেছে। এরপর যথারীতি সব আলোচনা বন্ধ। যেন কিছুই হয়নি। অথচ আমরা একটুও ভেবে দেখি না প্রতি বছর লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কত।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত আট বছরে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষ। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটাই আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন হলো কেন ঘটছে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা? এর কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অনেকগুলো বিষয়। প্রধানতম হলো অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। সেখানে নেই গেটম্যান, যা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া রয়েছে গেটম্যানের অবহেলা। ট্রেন আসার নির্দিষ্ট সময় থাকলেও গেটম্যানরা সঠিক সময়ে লেভেলক্রসিংয়ে প্রতিরোধ সিগন্যাল বন্ধ করেন না। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা।

এ ছাড়া কিছু গাড়ির চালক ও পথচারীর ধৈর্যের অভাবও লেভেলক্রসিং দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নিজেদের খামখেয়ালি মতো তারা রেললাইন পার হন। রেললাইনের পাশে যত্রতত্র বাস-ট্রাক রেখে দিয়ে জটের সৃষ্টি করছে। এ কারণেও ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। আর লেভেলক্রসিংয়ের আশপাশে সরকারি জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা তৈরি করছেন দোকানপাট। এমনকি লেভেলক্রসিংয়ের পাশে বাজারও বসছে নিয়মিত। আবার কোথাও কোথাও রেললাইনের দুই পাশে কাছাকাছি বসতি গড়ে উঠছে। আছে অসংখ্য বস্তিও।

এ দেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। এরপর সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে এর পরিধি বেড়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রেলপথ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর প্রচুর অর্থব্যয় করে সেগুলো মেরামতও করা হয়। সময়ের দীর্ঘ পথচলায় বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২,৮৭৭ কিলোমিটার রেললাইন নেটওয়ার্ক দেশের ৪৪টি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন রেলওয়ে পরিচালিত হতো। ১৯৭৩ সালে বোর্ডের কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।

তবে দীর্ঘদিন ধরে রেল খাতে ক্রমাগত অবহেলা আর ভুল পরিকল্পনার কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই রেল খাতকে বাঁচাতে দাবি ওঠে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার। পাশাপাশি রেলওয়েকে ঢেলে সাজাতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধি করে রেলপথের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রেল খাতে ক্রমাগত অবহেলা আর ভুল পরিকল্পনার কারণে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।

এ ছাড়া সেবার মানও নিম্নমুখী। সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি। আর প্রায় প্রতি বছর নিয়মিত লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা মানুষকে শঙ্কায় ফেলছে। দেশে ২ হাজার ৮০০-এরও বেশি লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি অবৈধ। অবাক করা তথ্য হলেও এটাই বাস্তবতা। এর মধ্যে গেটম্যান নেই ২ হাজার ২৫৮টিতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্র্র্তৃপক্ষ জানা সত্ত্বেও প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এই দুরবস্থা থেকে কবে পরিত্রাণ পাবে মানুষ? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটি চলে আসে। তবে এখন সময় এসেছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার। এর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় লেভেলক্রসিংয়ের পাশে লাল বাতি দীর্ঘক্ষণ জ্বালিয়ে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ট্রেন আসার আগে কোনো পথচারী অথবা যানবাহন লেভেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে পার হতে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে গেটম্যানকে সতর্ক থাকতে হবে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, লেভেলক্রসিং ফেলে রাখলেও যানবাহন জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। আবার লেভেলক্রসিং পার হতে গিয়েও অনেক পথচারী দুর্ঘটনার শিকার হন। এ ক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় অপরিকল্পিত ক্রসিং ও মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে ট্রেনে কাটা পড়ার ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামেও যেখানে লেভেলক্রসিং নেই, সেখানে অতি শিগগির ক্রসিং স্থাপন করা প্রয়োজন। এর জন্য ক্রসিংগুলোতে জনবল নিয়োগ দিতে হবে। যেসব ক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই, সেখানে গেটম্যান নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের অপমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। সম্ভব হলে প্রতিটি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করা যেতে পারে, যাতে কেউ ঝুঁকি নিয়ে লেভেলক্রসিং পার হতে কিছুটা হলেও ভয় পায়। অবশ্য উন্নত দেশে লেভেলক্রসিং কেন সেখানে রাস্তায় পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশও দেখা যায় না। সবকিছু ট্রাফিক সিগন্যালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ সে দেশের জনগণ অতিমাত্রায় ট্রাফিকসচেতন। কিন্তু বিপরীতে আমরা এসবের ধারই ধারি না। নিয়ম লঙ্ঘন করাই যেন আমাদের দেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। কারণ প্রতি বছর গড়ে একশোর বেশি মানুষ শুধু লেভেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মারা যায়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই এখনই এ বিষয়ে যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে রেল মন্ত্রণালয়কে। তবেই সম্ভব হবে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধ করা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close