শাকিবুল হাসান

  ১৪ আগস্ট, ২০২২

অভিমত

মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য রক্ষা জরুরি

বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী বলা হয় মহাস্থানগড়কে। এটি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে। প্রাচীন বাংলার এক জনপদের নাম পুণ্ড্র। সেই সময়ে বাংলায় যত জনপদ ছিল তার মধ্যে পুন্ড্রনগর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাটি পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেই পরিচিত ছিল। তবে কালের আবর্তে এটি মহাস্থানগড় নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহাস্থানগড় শব্দের ‘মহা’ মানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, আর ‘গড়’ অর্থ উচ্চস্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক কারণে এই স্থানের গুরুত্ব অনেক উঁচুতে। এ ছাড়াও এই স্থানটির ভূমি বেশ উঁচু; ফলে এটি মানুষের কাছে মহাস্থানগড় নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। পঞ্চম-ষষ্ট শতকে মৌর্য ও গুপ্ত রাজবংশের রাজাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল ততকালীন পুন্ড্রনগর তথা আজকের মহাস্থানগড়।

বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বগুড়া শহর থেকে উত্তর দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। সেন বংশের শাসনামলে এই স্থানের অত্যাচারী রাজা ছিল পশুরাম। রামের অত্যাচারে এই অঞ্চলের মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখনই শাহ সুলতান বলখী (রহ.) ইসলাম প্রচারের জন্য বলখী নগর থেকে এই অঞ্চলে আসেন। ধারণা করা হয়, তিনি মাছের পিঠে করে এই বরেন্দ্র অঞ্চলে এসেছিলেন। এই জন্য তিনি মাহিসাওয়ার নামেও সুপরিচিত। তার সঙ্গে পরশুরামের যুদ্ধ হয়; যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হয়। ফলে শাহ সুলতান (রহ.) এখানে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পেয়ে যান। তার মাজার শরিফ এখনো মহাস্থানগড়ে রয়েছে। বহুকাল বাংলার এই প্রাচীন নগরী ধ্বংসাবশেষ হিসেবে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও ১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন সর্বপ্রথম মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার কানিংহাম ধারণা প্রকাশ করেন এটিই ছিল পুন্ড্রবর্ধন।

১৯২৮-২৯ সালে এখানে প্রথম খননকার্য শুরু করা হয়। তাতে মহাস্থানগড় আবার জনসম্মুখে চলে আসে। মহাস্থানগড়ের

ধ্বংসাবশেষের আয়তন প্রায় ৭৮ বর্গকিলোমিটার। এতে রয়েছে প্রাচীনকালের তৈরি একটি ভাঙা দুর্গ, খোদার পাথর ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, লক্ষিন্দরের বাসরঘর হিসেবে পরিচিত গোকুল মেধ, মঙ্গলকোট, তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, মানকালির ঢিবি, ভাসু বিহার, ভিমের জঙ্গল, শীলাদেবীর ঘাট, কালিদহ সাগর, পরশুরামের প্রাসাদ ইত্যাদি সব পুরাকীর্তি। বর্তমানে মহাস্থানগড়ের প্রধান আকর্ষণ দৃষ্টিনন্দন মসজিদ এবং এর ডানপাশে সুলতান (রহ.) এর মাজার শরিফ। এর আশপাশে রয়েছে নাম জানা বহু লোকের কবরস্থান। এখানে দুধ কুশি নামে এক ধরনের পাথর আছে সেই আমলের। বলা হয়, এই পাথর তোলার জন্য ৭টি হাতিকে ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু পাথরটি আজও সেখানে রয়েছে। বর্তমানে এটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এই স্থান এখন ভন্ড সাধু, নেশাখোর এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকে আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে। মাজারে বিড়াল নিয়ে গিয়ে পোষা, মাজারকে সেজদা করা, মাজারের কাছে কিছু চাওয়া ইত্যাদি ইসলাম পরিপন্থি কাজকর্ম সেখানে সাইনবোর্ডের নির্দেশনা দ্বারা নিষেধ করা থাকলেও কেউই তা মানে না। দায়িত্ব প্রশাসনও যেন বছরের পর পর বছর দায়সারাভাবে পার করছে। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে সেখানে মেলার নামে জুয়া, দেহ ব্যবসা, নেশার আড্ডাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সেখানে যেন রোজকার ব্যাপার। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ভ্রমণপিয়াসু ঐতিহাসিক এই স্থান পরিদর্শনে আসে। আশপাশের অনেক জেলার মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য সেখানে মানত করে। বিশেষ করে শুক্রবারে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অনেকে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যও দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। সবাই মসজিদে নিজেদের সাধ্যমতো দান করে।

প্রশাসন এটি তত্ত্বাবধানে থাকলেও তাদের গাফিলতির চিত্র সেখানে গেলেই বোঝা যায়। সেখানকার অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য মহাস্থানগড়ের পুরোনো ইতিহাস, ঐতিহ্য, খ্যাতি সব ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পর্যটকরাও সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। প্রশাসনের উচিত আশপাশে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আনা। মহাস্থানগড় একটি ওলি-আউলিয়ার এলাকা। এখানে শায়িত আছেন বিখ্যাত ওলিয়ে কামেল। হজরত শাহ সুলতান বলখী (রহ.)। তার মাজারের পবিত্রতা রক্ষার্থে, এলাকার তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার ক্ষেত্রে মাদক বিক্রেতা, সেবনকারীসহ সেখানকার স্থানীয়দের অসামাজিক কার্মকান্ড বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। শুধু মসজিদের বস্তা বস্তা টাকার ভাগ-বাটোয়ারা করলে চলবে না। প্রাচীন এই রাজধানীকে রক্ষা করতে হবে। মাজার থেকে একটু পাশে পুলিশের একটা ফাঁড়ি করে নিয়মিত মনিটরিং করা যেতে পারে। এতে করে সহজেই এসব অপকর্মে জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং দমন করা যাবে। শুধু তাই নয়, পর্যটকদের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয়রা অনেক অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হয়, বিভিন্নভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। এ বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে হলেও প্রশাসনের পাশাপাশি এলাকার সচেতন জনতার উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে মহাস্থানগড়ের পবিত্রতা রক্ষার্থে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। সর্বোপরি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন তথা মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য, পবিত্রতা বজায় রাখা।

লেখক : শিক্ষার্থী বরেন্দ্র কলেজ, রাজশাহী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close