মো. মাঈন উদ্দিন

  ১৩ আগস্ট, ২০২২

অভিমত

বাড়তি ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে

সেই নব্বই দশকের শেষের দিকেও দেখতাম, দেশে বিদ্যুতের প্রচণ্ড সংকট ছিল। তখন ভূতুড়ে সন্ধ্যাকে আরো ভূতুড়ে করে তুলত লোডশেডিং। ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পর পড়ার প্রস্তুতি নিতেই বিদ্যুৎ চলে যেত। আমরা সেই সংকট কাটিয়ে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রয়াস পাচ্ছিলাম। বিশেষত, এই শতকের গোড়ার দিক থেকে আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে বর্তমান সরকারের আমলে আমরা বিদ্যুতের সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু বিধিবাম, মানুষের কাছে এই পৃথিবী কত অসহায় তা দেখিয়ে দিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কয়েক দফা করোনার ঢেউয়ের ধাক্কা কোনোমতে সামলে উঠতে যাচ্ছিল মানুষ। সে ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই অতি মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষ আজ দিশাহারা।

প্রতিদিনের খরচের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। হিমশিম অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন চালাতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে। এমন দুঃসময়ে আবারও বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে ৪৪ টাকা। এক লাফে জ্বালানি তেলের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বাড়িয়ে দিয়েছে দুশ্চিন্তা। মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে করেছে আরো দীর্ঘ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। সাধারণ মানুষের টিকে থাকার লড়াই আর কতকাল করতে হবে। জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধাপে খরচের চাপ বাড়াবে নিশ্চিত। কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত করবে। উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয়ের সঙ্গে পণ্যমূল্যও বৃদ্ধি পাবে। মানুষের পকেট থেকে টাকা যাবে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এতে স্থির ও সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। খেটে খাওয়া ও গরিব মানুষের বেঁচে থাকা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম অর্থনীতি ও জনজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এতে নিম্ন ও খেটে খাওয়া মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। স্থির ও সীমিত আয়ের মানুষ ও পেনশনভোগী বা যারা সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল তাদের ওপর চাপ আরো বাড়বে। জীবনযাত্রার মান আরো নিচে নেমে যাবে। সে সঙ্গে নতুন দরিদ্রের সংখ্যাও বাড়বে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের এই মূল্য সমন্বয় কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে- তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে কমছে সেখানে দেশের বাজারে এত হারে দাম বাড়ানো সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য এটা সঠিক সময় নয়।

গত শুক্রবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। ওই দিন রাত ১২টা থেকেই সরকারের এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ১১৪ টাকা লাগছে। এক লিটার অকটেনের জন্য দিতে হচ্ছে ১৩৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পেট্রল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা। এদিকে গতকাল শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।

ডিজেলের দাম বাড়াতে কৃষি খাতে সেচের খরচ বাড়বে এবং শিল্প খাতেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। যার প্রভাব পণ্যের দামেও পড়বে বলে জানান ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তারা বলেন, জ¦ালানির দাম বাড়াতে কৃষি ও শিল্প পর্যায়ে উৎপাদন খরচ ও পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি বাজারে জিনিসপত্রের দামে পড়বে। এমনিতেই বাজারে নিত্যপণ্যের দামে আগুন। তার ওপর নতুন করে দাম বাড়লে সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপ প্রকট হবে। অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টিকে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়বে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের আরো সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া দরকার ছিল। জ্বালানির দাম মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে উল্লেখ করে তারা আরো বলেন, দেশে এখন মূল্যস্ফীতি অনেক। এ অবস্থায় জ্বালানির দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডাবল ডিজিট মূল্যস্ফীতি দুশ্চিন্তার বিষয়।

জ্বালানি খাতের দুই-চারজন ব্যক্তির ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশের জনগণ জ্বালানি জ্বরে ভুগছে বলে মনে করেন অনেকেই। তারা বলেন, অকটেন ও পেট্রল দীর্ঘদিন যাবৎ আমদানি না করে গ্যাস ও ডিজেল রিফাইন কনডেন্সার থেকে এ দুটি জ্বালানি উৎপাদন করা হয়। এ দুটি জ্বালানির পর্যাপ্ত মজুদ আমাদের রয়েছে, যা বহু দিন যাবত জেনে এসেছি। কিন্তু কোনো থার্ড পারসন সিংগলার বা প্লোরেল নাম্বারের তর্জনীর ইশারায় আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দেশে উৎপাদিত এই দুটি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখক : সেকশন অফিসার, রেজিস্ট্রার দপ্তর

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close