মাসুদ রানা

  ১৩ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

বিশ্ব রাজনীতির কূটচালে বিদ্যুৎ সংকট

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অন্যতম রপ্তানিকারক ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা এবং এর প্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও তাদের মিত্র দেশগুলো। যার ফলে তেল-গ্যাসের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বেই চলছে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট। দিন দিন সেই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশ জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিদ্যুতের অভাবে হুমকির মুখে পড়েছে শিল্প কলকারখানার কার্যক্রম, থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা।

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ফলে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানি। এই সংকটকে স্মরণকালের অন্যতম আখ্যা দিয়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী রোবার্ট হাবেক বলেছেন, ‘রাশিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস আমদানি কমিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ফের সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়েছেন তিনি।

একদিকে যুদ্ধের প্রভাব, অন্যদিকে ইউএস ডলারের বিপরীতে ইয়েনের ভয়াবহ দরপতনে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে পড়তে চলেছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান। তার ওপর পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলেছে টোকিওতে তীব্র দাবদাহ। দেশটির চাহিদার ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বিশাল অঙ্কের অর্থ পরিশোধে বিপাকে পড়েছে এশিয়ার অন্যতম শক্তিধর অর্থনীতির দেশটি।

চরম বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে আরেক ধনী দেশ অস্ট্রেলিয়াও। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বাসিন্দাদের দুই ঘণ্টা বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন। বিশ্বে কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিতে তালিকার শীর্ষের দিকে রয়েছে দেশটি। দেশটির তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎই কয়লা ব্যবহার করে উৎপাদন করা হয়। তারপরও গত মাস থেকে বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে দেশটি। নানা সমস্যার মুখে দেশটির চার ভাগের এক ভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী কয়লা ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়েছে।

গত ৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ভারত। জম্মু-কাশ্মীর থেকে অন্ধ্র প্রদেশ পর্যন্ত ২ থেকে ৮ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নাকাল অধিবাসীরা। দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে কয়লার মজুদ কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে দেশটি। গ্রীষ্মের দাবদাহ বিদ্যুতের চাহিদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশটির অন্তত ১৫০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি প্রতিবেশী আরেক দেশ পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে দেশটির টেলিকম অপারেটররা।

চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশও বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। বৈশি^ক এই সংকটের ঊর্ধ্বে নয় আমাদের দেশও। জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংস্কারের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রুটিনমাফিক লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। পিডিবি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান জানান, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। তাছাড়া দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম। এর বাইরে আরো কয়েকটি কারণ আছে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, সেই কাজ চলছে। ভারত থেকে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত, ওদের ওই কেন্দ্রটির সমস্যা হয়েছে ফলে সেটাও আসছে না।

বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। আর সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সর্বমোট উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। তাই সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একসঙ্গে উৎপাদনে যেতে হয় না। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মেটাতে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো উত্তোলনের পাশাপাশি ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে এ জ¦ালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ফলে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহারের সক্ষমতা থাকলেও তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত রয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। গ্যাসের ঘাটতির কারণে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শিগগিরই এই ঘাটতি পূরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের চড়া দামে বিপদে বাংলাদেশ। ২০১৮ সাল থেকে চাহিদা বড় একটা অংশ আসছে আমদানির মাধ্যমে। এর মধ্যে নতুন আঘাত হানল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউরোপজুড়ে চাহিদার ৪০ শতাংশের বেশি গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। কোনো কোনো দেশের চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করে রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হলে গ্যাসের জন্য এশিয়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে ইউরোপের দেশগুলোর। গ্যাসের জন্য বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা এশিয়া, মূলত কাতারের ওপর। সেই কাতারকেই ইউরোপে সরবরাহ বাড়াতে নির্দেশনা দিয়েছে জো বাইডেন প্রশাসন। ফলে দামের চেয়েও আমাদের জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তা প্রয়োজনীয় গ্যাসের প্রাপ্তি নিয়েই।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবার সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ একটি চলমান ব্যবস্থা, এটি মজুদ করার কোনো সুযোগ নেই। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে হয়। কাজেই উৎপাদন ব্যাহত হলে লোডশেডিং হবেই। বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আমাদের দেশ অনেকটাই পিছিয়ে। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করে ফেলেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্য সব দেশের মতো বিদ্যুৎ-সংকটে পড়েছে বাংলাদেশও।

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সারা দেশে এলাকাভেদে বিভিন্ন সময়ে দিনে এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। সপ্তাহে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাত ৮টার পরে বন্ধ থাকছে বিপণিবিতান ও শপিং মল। সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে আছে জ¦ালানিখাতে বাজেট ২০ শতাংশ কমানো, শারীরিক উপস্থিতিতে সভা যথাসম্ভব পরিহার করা এবং অধিকাংশ সভা অনলাইনে করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করা। প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্তগুলোর সঠিক বাস্তবায়েেনর পাশাপাশি বিদ্যুতের অপচয় রোধে আমাদের সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। অপ্রয়োজনে একটি বাতি, ফ্যান বা এসি চালিয়ে রাখার কারণে পরবর্তীতে আপনাকে ভোগ করতে হতে পারে এক বা দুই ঘণ্টার লোডশেডিং। সামর্থবানদের বিলাসিতার জন্য অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে, গরমে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। আমাদের দেশে এখনো যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে জনদুর্ভোগকে অনেকটাই সহনীয় মাত্রায় নামানো যাবে।

অপচয় ও দুর্নীতি রোধে সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মীর যোগসাজশে পাওয়া অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্নকরণ ও সিস্টেম লস সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুতের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি আনুকূল্যের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। এছাড়া এনার্জি সেভিংস বাল্ব কমমূল্যে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ করাসহ সবদিক বিবেচনায় নিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ আর আপামর জনগণের সচেতনতার অভাবে যদি আমরা বিদ্যুতের সর্বোচ্চ সুষম ব্যবহারে ব্যর্থ হই, তাহলে তার চড়ামূল্য দিতে হবে জনগণ তথা গোটা দেশকে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close