হাসানুল বান্না অলি
মুক্তমত
স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের লক্ষ্য
পৃথিবীতে চলমান চিন্তাশীল মানুষের কোনো না কোনো একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছেই। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। লক্ষ্য ছাড়া জীবন যেন মাঝি ছাড়া নৌকার মতো। যেকোনো সময় এই নৌকা থেমে যেতে পারে কিংবা এলোমেলো অথবা উল্টাপাল্টা পথে চলতে পারে। তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে উন্নয়নের জন্য অবশ্যই লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তবে সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন হবে সেটাও স্বাভাবিক।
যেমন- একজন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে, তাহলে সে অবশ্যই বলবে, আলেম, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যারিস্টার অথবা একজন শিক্ষক। সদ্য মাস্টার্স শেষ করা একজন ব্যক্তিকে যদি একই প্রশ্ন করা হয় তাহলে সে বলবে ভালো একটা সরকারি চাকরি অথবা ভালো কোনো ব্যবসা। কেউবা বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়া আবার কেউ জনসেবক হওয়ার স্বপ্নকেই নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য মনে করে। জীবনকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার দায়িত্ব প্রত্যেকের আপন কাঁধেই বর্তায়।
আবার কারো কারো জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হলো সুখী ও পরিতৃপ্ত হওয়া। শুধু জীবন ও মৃত্যু পর্যন্ত যাদের বিশ্বাস, তাদের লক্ষ্য শুধু পার্থিব জীবনে সুখী ও পরিতৃপ্ত হওয়া। আর যারা মৃত্যুর পরের জীবনের বিশ্বাস করেন তারা সেই জীবনেও সুখী ও পরিতৃপ্ত হতে চান আর সেজন্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনকে অপরিহার্য মনে করেন। স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করতে তার নির্দেশিত বিধানগুলো পালন করাই তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
মুমিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, ‘প্রকৃত মুমিনরা বলবে আমি, একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফেরাচ্ছি, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৭৯) আবার যদি কেউ বলে, তার জীবনের লক্ষ্য হলো ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, বিসিএস ক্যাডার তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? তখন আমাদের মনে রাখতে হবে এগুলো হলো পেশা আর পেশা কোনো দিনও জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। এগুলো লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। এই মাধ্যমগুলোকে লক্ষ্য মনে করলে ভুল পথে হাঁটার শামিল হবে।
যে ব্যাক্তি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে তার জন্য আখেরাতের সফলতা অবধারিত হয়ে যায়। শুধু আখেরাতের সফলতাই শেষ নয় বরং যে মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্য নেয় তার সঙ্গে সঙ্গে তার আল্লাহর সন্তুষ্টি জাগতিক জীবনও কল্যাণ ও বরকতে ধন্য হয়। আল্লাহ তার চলার পথকে সহজ করে দেন। তার জন্য রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টির বিনিময়ে (হলেও) আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ মানুষের দায়িত্ব নির্বাহে তার সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিনিময়ে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাকে মানুষের ওপরই সোপর্দ করে দেন।’ (তিরমিজি শরিফ)
সুতরাং; এগুলো কারো লক্ষ্য হতে পারে না বরং লক্ষ্য হওয়া উচিত এগুলোর মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। সেই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম হতে পারে যেকোনো পেশা। লক্ষ্য যখন স্রষ্টার সন্তুষ্টি, তখন আনুষ্ঠানিক ইবাদত আর মানবসেবা হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। স্থির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই লক্ষ্য ও মাধ্যমের এই আন্তসম্পর্ক ভালোভাবে বুঝতে হবে। এ বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় অনেকেই মাধ্যমকে লক্ষ্য মনে করে ছুটতে থাকে আর এ কারণেই শেষে অসুখী ও অতৃপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। কেউ যদি ডাক্তার হয় হোক তাতে কোনো সমস্যা নেই। সে মানুষকে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে তার মূল লক্ষ্য রবের সন্তুষ্টি লাভ করবে। কেউ আইনজীবী হলে সেই মানুষকে আইনের সঠিক সেবা দানের মাধ্যমে রবের সন্তুষ্টি অর্জন করা যেতে পারে। একই কথা সব পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
আমাদের (মুমিনদের) মূল লক্ষ্য ও সফলতা হলো স্রষ্টার সন্তুষ্টি সুতরাং এটা যেকোনো মাধ্যমেই হতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আত্মবিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৭) সুতরাং লক্ষ্য অর্জনে মাধ্যমকে পুঁজি করে পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে জীবন ধারণের সব চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করাও সম্ভব। যেমন : কোনো ডাক্তার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীর সেবা করেন তাহলে সেবার সঙ্গে তিনি অর্থও উপার্জন করতে পারবেন। অর্থ নিয়ে তাকে চিন্তা করা লাগবে না। মানুষের ভালোবাসা এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টিও পাওয়া যাবে। কিন্তু ডাক্তারি পেশার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে যদি লক্ষ্য ধরা হয় আর সব মনোযোগ যদি অর্থের দিকেই থাকে, তাহলে হয়তো অর্থ আসবে কিন্তু এর বিপরীতে অনেক কিছু হারাতে হবে এমনকি স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
একজন ইমানদারের সর্বশেষ ঠিকানা এবং চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির জায়গা হলো জান্নাত। জান্নাতের অধিবাসীদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ জান্নাতিদের ডেকে বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছো?’ তারা জবাব দেবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের যে অপরিসীম নিয়ামতে ধন্য করেছেন, তাতে কী করে আমরা অসন্তুষ্ট থাকতে পারি! তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তোমাদের এর চেয়েও উত্তম নিয়ামত দেব। তা হলো, এখন থেকে আমি তোমাদের প্রতি চিরসন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। আর কখনো অসন্তুষ্ট হব না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং সবাইকে লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে, লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম ঠিক করতে হবে এবং লক্ষ্যে স্থির থেকে সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
"