এহসান বিন মুজাহির

  ১২ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

সত্যের পথে থাকার শিক্ষা দেয় ‘কারবালা’

মানবজাতির পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করছে পবিত্র মহররম মাস। বিশেষ করে ঐতিহাসিক কারবালার রক্তঝরা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহররম মাস আরো স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)।

কারবালার সূত্রপাত : ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর মোতাবেক ৬১ হিজরির ১০ মহররম ফুরাত নদীর তীরে ইরাকের তৎকালীন রাজধানী কুফার ২৫ মাইল উত্তরে কারবালার মরুপ্রান্তরে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। ওইদিন কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নরপিশাচ সীমারের হাতে শাহাদতবরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হজরত হোসাইন (রা.) অল্পসংখ্যক সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে জালিম শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন কারবালা প্রান্তরে। সেদিন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশি রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল। জালিম শাসক ইয়াজিদ চেয়েছিল মুসলিমজাহানের ক্ষমতা হিসেবে হজরত হোসাইনের (রা.) পক্ষ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে। যদি হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে মুসলিমজাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নিতেন তাহলে সেই কারবালা আর হতো না। কিন্তু হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি, তথা আপস করেননি। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জালিম শাসকের প্রতি আনুগত্য তথা সমর্থন দেওয়ার চেয়ে শহীদ হওয়াই শ্রেয়। অন্যায়-অসত্য এবং স্বৈরাচারী শাসকের কাছে তিনি মাথা করেননি। তাই ইয়াজিদ ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত হোসাইনকে (রা.) হত্যার জন্য বিভিন্ন সুযোগ খুঁজতে থাকে।

ইয়াজিদ ছিলেন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী। মুসলিমজাহানের খলিফা হতে চেয়েছিলেন ইয়াজিদ। কিন্তু আদর্শহীন এবং অসৎ চরিত্রের কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে হজরত হোসাইন (রা.) ছিলেন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। তিনি সব শ্রেণির মানুষের কাছে ছিলেন সম্মানের পাত্র। ফুফাবাসী ইয়াজিদের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন, যার কারণে তারা হজরত ইমাম হোসাইনকে (রা.) কুফায় আসার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। হজরত হোসাইন (রা.) কুফাবাসীর দাওয়াত পেয়ে কুফার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তার ভাই মুসলিমকে কুফায় প্রেরণ করেন। হজরত মুসলিম (রা.) কুফার অনুকূল পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে হজরত হোসাইনকে (রা.) কুফায় যাওয়ার জন্য পত্র লিখলেন। পত্র প্রেরণ করার অল্পক্ষণ পরই কুফার শাসনকর্তা হজরত মুসলিমকে হত্যা করে এবং নিমন্ত্রণকারীরা তথা কুফাবাসীরা জালিম শাসক ইয়াজিদের পক্ষে যোগদান করে। মুসলিম (রা.)-এর শাহাদতের সংবাদ না জানার কারণে তিনি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়স্বজন, ভক্ত-অনুচরসহ দুই শতাধিক মানুষ নিয়ে কুফা অভিমুখে রওনা হয়েছিলেন। কুফায় পৌঁছামাত্রই পাষ- ইয়াজিদ এবং তার দোসররা হজরত হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গী-সাথিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে বললেন, আমরা তো এখানে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসিনি। বরং কুফাবাসীর নিমন্ত্রণ পেয়েই এসেছি। কিন্তু কুফাবাসী যে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা আমাদের জানা ছিল না। আপনি আমাদের ওপর আর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবেন না, আমরা কুফা থেকে চলে যাব, আপনি আমাদের গন্তব্যস্থলে চলে যাওয়ার সুযোগটুকু দিন।

নিষ্ঠুর ইয়াজিদ হোসাইন (রা.)-এর কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেনি বরং সে তার দল-বল নিয়ে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। নবীর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে বারবার বোঝাতে লাগলেন, দেখো আমি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি। তুমি মুসলমান, আমিও মুসলমান। আমাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করো, তোমার মঙ্গল হবে। এত কিছু বলার পরও পাষ- ইয়াজিদ আক্রমণ থামায়নি। শেষপর্যায়ে হজরত হোসাইন (রা.) তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে ইয়াজিদের সঙ্গে লড়ায়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। উভয়ের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। সত্য-ন্যায়ের পক্ষে হজরত হোসাইন (রা.)-এর সৈন্যসংখ্যা মাত্র ষাট-সত্তরজন। এর মধ্যে নিষ্পাপ কচিকাঁচারা ও নারীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। আর অন্যদিকে ইয়াজিদ তথা অন্যায়-অসত্যের পক্ষের সংখ্যা বহু গুণে বেশি। যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলাকালীন হজরত হোসাইন (রা.)-এর বালক শিশু আলী আজগরসহ অন্য শিশুরা পানি, পানি বলে চিৎকার করছে। পানির জন্য তারা ছটফট করছে কিন্তু পাষ- ইয়াজিদ ও তার সৈন্যবাহিনী পানি দেওয়া দূরের কথা বরং তারা নিষ্পাপ শিশু ও নারীদের ওপরও নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করে দিল। বালক-শিশুরাও তাদের সামর্থ্যরে আলোকে ইয়াজিদ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে কারবালার যুদ্ধে শরিক হলো। অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়-সত্যের জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। নীতি-আদর্শ এবং অন্যায়-অসত্যের পক্ষে আপস করেননি। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এবং ‘কারবালা’ আমাদের সত্যের পথে অবিচল থাকার শিক্ষা দেয়।

আশুরার গুরুত্ব : মহররম মাসে বহু স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় বিভিন্ন দিক দিয়ে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মহররমের দশম দিবসে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে-১. আকাশ জমিন পাহাড়-পর্বত সবকিছুর সৃষ্টি। ২. আদম (আ.)-কে সৃষ্টি। ৩. নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ। ৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বালিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ। ৫. দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ। ৬. হজরত সুলাইমান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্বদান। ৭. হজরত ইউনুস (আ.)-কে ৪০ দিন পর দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার। ৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা। ৯. হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন এবং জীবিতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন। ১০. হজরত ইদ্রিস (আ.)-কে আসমানে উত্তোলন। ১১. হজরত দাউদ (আ.)-কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত। ১২. গাজওয়ায়ে খায়বার বিজয় অর্জন। ১৩. মাদায়েন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিজয় অর্জন। ১৪. প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা এবং একই দিনে তার জান্নাতে প্রবেশ। ১৫. হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সঙ্গে বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ। ১৬. হজরত নূহ (আ.)-কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ প্রদান। ১৭. হজরত সোলায়মান (আ.)-কে হারানো বাদশাহি ফিরিয়ে দেওয়া। ১৮. হজরত ইয়াকুব (আ.) কর্তৃক হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ। ১৯. সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে আগমন। ২০. হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শহাদতবরণ। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৩২, উসদুল গাবাহ, ১/২১ ফাতহুল বারী, ৪/২৯১)

আশুরার আমল : আশুরার কারণে মহররম মাসের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহতায়ালার প্রিয় মাস মহররম। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বিধান ও গণনা হিসেবে মাস হলো বারোটি আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত। সুতরাং এ মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। (সুরা তাওবাহ : ৩৬) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমন করলেন, দেখলেন মদিনার ইহুদিরা আশুরার দিবসে রোজা পালন করছে। তাদের রোজা রাাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এই দিনটি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিনে আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.) এবং তার সম্প্রদায় বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং তার ওপর বিজয় দান করেছেন। আর তারই শুকরিয়া হিসেবে এদিনে মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ২৬৫৩) হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রমজানের রোজার পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মহররমের রোজা। (তিরমিজি : ২৪৩৮) হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, আশুরার রোজা তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়নি বটে, কিন্তু আমি এই দিন রোজা রাখব। যার ইচ্ছা হয় সে এই রোজা রাখতে পারো এবং ইচ্ছে হলে তা ছাড়তেও পারো। (বুখারি : ১৮৬৫) রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং এই দিনে ইহুদিদের রোজার বিরোধিতা করো। তোমরা আশুরার রোজার সঙ্গে আগে অথবা এক দিন পরে আরো একটি রোজা মিলিয়ে রাখবে। (বুখারি : ১৮৬৫) আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে নবীজি সা. বলেন, আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম : ১১৬২) তবে ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে এক দিন রোজা রাখে। তাদের রোজার সঙ্গে যেন মুসলমানদের রোজার সাদৃশ্য না হয়, তাই মুসলমানরা আশুরার রোজার সঙ্গে ৯ অথবা ১১ তারিখে আরো একটি রোজা বৃদ্ধি করে মোট দুটি রোজা রাখতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের আশুরার রোজা রাখার তৌফিক দান করুন।

লেখক : প্রিন্সিপাল

শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close