আফতাব চৌধুরী

  ০৯ আগস্ট, ২০২২

মুক্তমত

পবিত্র আশুরার শিক্ষা

মাসের নামটাই মহররম, পবিত্রতার পরিচয় বহন করে। এই মাসটি ইসলামি বছরের প্রথম মাস হওয়ায় এবং এ মাসের ১০ তারিখ আশুরা হওয়ায় এর মর্যাদা বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। আশুরা বিশ্বজাহানের অনেক গুরুত্ববহ ও রহস্যময় ঘটনার নীরব সাক্ষী। জানা যায়, আল্লাহ জাল্লা শানুহু নূরে মুহম্মদি সৃষ্টির মাধ্যমে নিজে জাহির হয়ে সৃষ্টি জগতের সূচনা করেন এবং তার হাজার হাজার বছর পর সেই নূর থেকে একে একে সবকিছু সৃষ্টি করেন।

পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টিপাত হয় এক আশুরাতে। প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর দেহে প্রাণের স্পন্দন সঞ্চারিত করা হয় এক আশুরাতে। হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়াকে (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করানো হয় এক আশুরাতে। হজরত আদম আলাইহিস সালাম পৃথিবীর যে স্থানে অবতরণ করেন, সেটা হচ্ছে বর্তমান শ্রীলঙ্কার রত্নাপুর এলাকার একটি পর্বতচূড়া, যাকে খ্রিস্টানরা বলে অ্যাডামস পিক। মুসলমানরা বলে বাবা আদম পাদম আর হিন্দু ও বৌদ্ধরা বলে শ্রীশ্রী পাদম।

মা হাওয়া (আ.) অবতরণ করেন জেদ্দায়। এই দুটো স্থানই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল বর্তমান লেখকের। শ্রীলঙ্কায় সমুদ্রের নিচে একটি স্থান আছে, যা অ্যাডাম ব্রিজ বা আদম সেতু নামে পরিচিত। মা হাওয়া ও বাবা আদম কয়েক হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থান করে জান্নাতে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাবার কারণে পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ‘রাব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়াতারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরিন’ বলে তওবা করেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু অবশেষে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উছিলায় তাদের তওবা কবুল করেন, সে এক আশুরাতে।

জেদ্দায় মা হাওয়া (আ.) মাজার শরিফ জিয়ারত করার সৌভাগ্য হয়েছে বর্তমান লেখকের। সে মাজার শরিফের দেয়ালে লেখা আছে, মাকবারা উম্মুনা হাওয়া। যুগে যুগে আশুরায় অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : হজরত নূহ আলায়হুস সালামের সময়কালে মহাপ্লাবনের পরিসমাপ্তি ঘটে আশুরায়। তিনি ৪০ দিন কিস্তিতে ভাসতে ভাসতে জুদি পাহাড়ে এসে সঙ্গীদের নিয়ে অবতরণ করেন। হজরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পান আশুরায়। এমনিভাবে হজরত ইউনুস (আ.)-এর ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে উদ্ধার লাভ, ৪০ বছর পর হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে মিলিত হওয়া, হজরত সোলায়মান (আ.)-এর হারানো রাজত্ব ফিরে পাওয়া, হজরত আইয়ুব (আ.)-এর ১৮ বছর মারাত্মক রোগে ভোগার পর আরোগ্য লাভ, হজরত মুসা (আ.)-এর নিজ কওম বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়া এবং বিরাট সেনাবাহিনীসহ ফেরাউনের সাগরের পানিতে ডুবে সলিলসমাধি প্রভৃতি অসংখ্য ঘটনার নীরব সাক্ষী আশুরা। ভবিষ্যতে এক আশুরার শুক্রবারে কিয়ামত সংঘটিত হবে।

আশুরার মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে রমজান মাসের সিয়াম ফরজ হওয়ার আগে প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং তার নির্দেশে সাহাবায়ে কেরাম আশুরায় সিয়াম পালন করেছেন, এমনকি রমজানের ফরজ সিয়াম পালন করলেও আশুরার নফল সিয়ামও পালিত হতে থাকে। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, রমজানের সিয়ামের পর উত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম।

মহররম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ঐতিহাসিক কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহররম হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য, ন্যায় ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ কায়েম করার জন্য, অন্যায়-অবিচার, জুলুমণ্ডনিপীড়ন প্রতিহত করে হক ও ইনসাফের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার জন্য কারবালা প্রান্তরে নিজের পবিত্র প্রাণ কোরবান করার মধ্য দিয়ে যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা পৃথিবীর মানুষকে ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ দিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

হজরত ইমাম হোসাইন প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র। এই দৌহিত্র সম্পর্কে তিনি বলতেন, হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। সেই ইমাম হোসাইনকে যারা শহীদ করল তারা নিঃসন্দেহে নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করার যোগ্য নয়, তারা প্রকৃত অর্থেই ইসলামের শত্রু, মানবতার শত্রু, সত্য ও ন্যায়ের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর বলেন, হোসাইনের কতল আসলে ইয়াজিদের মরণ হয়েছে। ইসলাম জিন্দা হয়ে ওঠে প্রতি কারবালার পর। আশুরা একটি পবিত্র দিন। শিরক, বিদাত ও কুসংস্কারমূলক কাজ করে যেন আমরা আশুরার পবিত্রতা বিনষ্ট না করি এবং সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করি।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close