রাজু আহমেদ

  ০৯ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম। পবিত্র কোরআনে এ মাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত যে মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম করা হয়েছে তার মধ্যে মহররম অন্যতম। বহুবিধ কারণে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহর কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে এ মাসকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর প্রিয় মহররম মাসের সাওম এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের নামাজ’। অন্যদিকে মানবতার মুক্তির দিশারি, সব নবী-রাসুলের নেতা এবং আমাদের পথপ্রদর্শক হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধরাবাসীর প্রতি তার দায়িত্ব অর্থাৎ মানুষকে শান্তির ধর্ম ইসলামের পথে আহ্বানের শুরু করেছিলেন মহররম মাসে। পবিত্র কোরআনে আরবি ১২ মাসের মধ্যে মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে এবং কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা গ্রন্থ অর্থাৎ বিভিন্ন হাদিস শরিফে এ মাসগুলোর স্বতন্ত্র ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। মহররম মাসের ১০ তারিখ গোটা মুসলিম বিশ্বের কাছে পবিত্র আশুরা নামে পরিচিত। আশুরা ও মহররম শব্দদ্বয় শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এক ভয়ংকর, বীভৎস, নিষ্ঠুর, নির্মম ও ইসলামের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নয়নের পুতুলি, কলিজার টুকরো, খাতুনে জান্নাত নবীনন্দিনী হজরত ফাতেমা (রা.)-এর আদরের দুলাল হজরত সোসাইনের কারবালার প্রান্তরে শাহাদতের মর্মন্তুদ ঘটনা; যা এ পৃথিবীর এক করুণ ইতিহাস। বিশ্বের সব মুসলিম নর-নারী আজও ধর্মীয় রীতিনীতির মাধ্যমে দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর ফোরাতের তীরে কারবালার কংকরময় প্রান্তরে মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মোয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদের হাতে শাহাদতবরণ করেন। এ অধ্যায়কে ইসলামের ইতিহাস আজও বেদনার রক্ত দিয়ে লেখা রয়েছে। তবে কারবালার এ করুণ ট্র্যাজেডির পরই ইসলাম নবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে বলেই ইসলামি স্কলারদের বিশ্বাস। তাদের মতে, ‘কারবালার ত্যাগের পরই ইসলাম জিন্দা হয়েছে’। কারবালাই মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে গেছে, মর্সিয়া কিংবা ক্রন্দন নয় বরং ত্যাগ চাই।

মুসলমানদের কাছে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। প্রিয়নবী (সা.)-এর অতি আদরের দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ফোরাতের উপকূলে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক আহলে বাইয়াতসহ কারবালার কংকরময় প্রান্তরে শাহাদতের ঘটনাকেই আমরা মহররম ও আশুরার একমাত্র ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করে থাকি। মূলত আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে শুধু কারবালার নিষ্ঠুরতার ঘটনাই জড়িত নয় বরং কারবালার আহলে বাইয়াতের শাহাদতের ঘটনা আশুরার শেষ ও চূড়ান্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা মাত্র। ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এ দিনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনটি একটি পবিত্র দিন, কেননা এ দিনেই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এদিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। ১০ মহররম আল্লাহ নবীদের নিজ নিজ শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিনে নবী মুসা (আ.)-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। হজরত নূহ (আ.)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তিনি জুদি পর্বতশৃঙ্গে নোঙর ফেলেছিলেন এই দিনেই। এই দিনে হজরত দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল হয়েছিল, নমরুদের কবল থেকে হজরত ইব্রাহিম (আ.) উদ্ধার পেয়েছিলেন, হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন। এদিনে হজরত ইসা (আ.)-কে আল্লাহতায়ালা ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘১০ মহররম কেয়ামত সংঘটিত হবে।’ (আল-হাদিস)

হিজরি ৬০ সনে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে। অথচ ইয়াজিদ প্রকৃত মুসলমান ছিল না বরং মোনাফেক ছিল। সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মধ্যপানকে সে বৈধ ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিবাহ করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল। শাসক হিসেবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। এসব কারণে হজরত হোসাইন (রা.) শাসক হিসেবে ইয়াজিদকে মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং কুফাবাসীর আমন্ত্রণ ও ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদিনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। উল্লেখ্য, উমাইয়াদের শাসনামালে ইসলাম তার মূল গতিপথ হারিয়ে ফেলেছিল। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় উমর ইবনে সা’দ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা পর ইসলামের জঘন্য দুশমন শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে আবি ওক্কাসের বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়। অবশেষে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। এ যুদ্ধ সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। এ অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭২ জন সঙ্গী শাহদতবরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে ইমাম হোসাইনের কণ্ঠদেশে ছুড়ি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। আর সে বেদনাহত দিনটা ছিল হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম। (তথ্য সূত্র-উইকিপিডিয়া)

ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে। শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে। আশুরা উপলক্ষে ৯ এবং ১০ মহররম তারিখে অথবা ১০ এবং ১১ মহররম তারিখ রোজা রাখা সুন্নত। আল্লাহর রাসুল (সা.) এ তারিখে রোজা পালন করতেন, তবে তার সাহাবিদের পালন করতে আদেশ দেননি। এ ছাড়া মুসলমানরা এদিন উত্তম আহারের চেষ্টা করে। মহররম বা আশুরা আজ গোটা মুসলিম বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে কিন্তু এর মূল শিক্ষা ও তাৎপর্যকে হারিয়ে আজ আমরা এ দিবসটিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকৃতভাবে পালন করছি। আজকে আমাদের অবস্থা হয়েছে সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন উচ্চারিত উক্তির

মতো। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বের যে ঘটনা যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে ব্যক্তি যত বেশি ?মর্যাদাসম্পন্ন, সে ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব তত বেশি কিংবদন্তি ও রূপকথার আবরণে আচ্ছাদিত এবং তত বেশি ভুল বোঝাবুঝিতে নিমজ্জিত।’ (কিতাবুল হবার মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন)।

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনায় মুসলমানদের জন্য ব্যাপক শিক্ষা রয়েছে। (ক) কারবালার ঘটনা মুসলমানদের মিথ্যার সঙ্গে আপস না করা এবং সত্যের পতাকাকে সমুন্নত রাখার চেতনাকে জাগ্রত রাখার শিক্ষা প্রদান করে। মহানবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর আহলে বাইয়াত ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে শাহাদতের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রথম শিক্ষা হচ্ছে একজন প্রকৃত সত্যাশ্রয়ী নিষ্ঠাবান খাঁটি মুমিন ও মর্দে মুজাহিদ কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না। প্রিয়নবী (সা.)-এর চিরন্তন বানী, ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সব অবস্থায় সত্য কথা বলা আর সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্যাতন ও অপবাদকারীর অপবাদ ও নির্যাতনের ভয় না করা’। হজরত হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে নিজের জীবন ও স্বল্প দুধের শিশু আবদুল্লাহ (আজগর)-কে এবং কিশোর কাসেমসহ ৭২ জন আহলে বাইয়াতের কারবালার কংকরময় প্রান্তরে তাজা খুনে রঞ্জিত করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর সত্যের পতাকাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে আল্লাহ পরিপূর্ণ দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়ার চেতনার ও প্রেরণাকে চির জাগ্রত রেখে গেছেন। (খ) কারবালার ঘটনা পরিপূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জিহাদের শিক্ষা দেয়। (গ) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্বে সংগ্রামের চেতনা জাগ্রত করে। (ঘ) কারবালার অন্যতম শিক্ষা হলো, অসৎ নেতৃত্বের পরিবর্তে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ইমানের দাবি। হজরত হোসাইন (রা.) কারবালার নির্মম শাহাদত মূলত অসৎ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিছক রাজনৈতিক আন্দোলন বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আলোচনা নয় বরং প্রতিটি মুসলিম উম্মাহের জন্য ইমানের অপরিহার্য দাবি, এ সত্যের মহান শিক্ষা ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখে গেছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদে আল্লাহর পরিপূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ইমানদার, মুত্তাকি, সৎ কর্মশীল ও যোগ্যতম ব্যক্তিদের নিজেদের শাসক ও নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা মুসলিম উম্মাহর জন্য নামাজ ও রোজার মতো ফরজে আইন; এই মহান চেতনা হজরত হোসাইন (রা.) এবং আহলে বাইয়াত নিজেদের জীবন বিলিয়ে জাগ্রত রেখেছেন। (ঙ) কারবালার ঘটনা জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ, ত্যাগ ও কোরবানির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কবির ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close