আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ০৮ আগস্ট, ২০২২

বিশ্লেষণ

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য

আরবি ‘শাহরুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মাস, আর মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। সুতরাং ‘শাহরুল মহররম’-এর যৌগিক অর্থ হলো সম্মানিত মাস। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। আরবি আশারা থেকে এর উৎকলন। যার অর্থ হচ্ছে দশ। আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এই দিনে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে আল্লাহতায়ালা যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ মহররম। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমাবারে হজরত ইস্রাফিল (আ.)-এর ফুঁতকারে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কিয়ামত। এ ছাড়া ইসলামের আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে এ দিনটির অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।

মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বহু বর্ণনা এসেছে। এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট আমল হলো আশুরার রোজা। হজরত আলী (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে কি? যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন। তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুল (সা.)-এর কাছেও জনৈক সাহাবি করেছিলেন। তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে নবীজি বলেছিলেন, ‘রমজানের পর তুমি যদি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিনে আল্লাহতায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরিমিজি, হাদিস : ১১৫৭)

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছান, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছো কেন? উত্তরে তারা বলল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফেরাউন ও তার বাহিনীকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবীজি বললেন, ‘হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ করলেন।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৩৩৯৭)

মুসলিম শরিফের অপর এক হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার দির্দেশ দেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) ইহুদি-নাসারাও এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যাবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে নবীজি বললেন, ‘তারা যেহেতু এ দিনে একটি রোজা পালন করে, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুদিন রোজা পালন করব।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১১৩৪)

ইমাম শাফেয়ি ও তার সাথিরা, ইমাম আহমদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেন না নবীজি দশ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং নয় তারিখ রোজা রাখতে নিয়ত করেছেন। হজরত আবু কাতাদা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজিকে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১১৬২)

দশ মহররম তথা আশুরায় মুসলমানদের জন্য অনেক খুশির ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি সংঘটিত হয়েছে হৃদয়বিদারক ঘটনাও। আর তা হলো শোহাদায়ে কারবালার ঘটনা। যদিও মহররম মাসে অনেক আনন্দপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু শোহাদায়ে কারবালার শোক যেন সেসব আনন্দকে মøান করে বুকের মধ্যে জাগিয়ে তুলে বিষাদের ঢেউ। স্বয়ং নবীজি যাকে নিজ পিঠে বসিয়ে বলতেন, ‘উত্তম বাহন পেয়েছো, তোমরাও উত্তম চালক,’ সেই ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ ৭২ জন আহালে বায়াতের মর্মান্তিক শাহাদতে কার না হৃদয় গলে? হোসাইন (রা.) শুধু নবীজির দৌহিত্রই ছিলেন না, ছিলেন তার আদর্শের প্রতীক। নবীজি তো স্পষ্টই বলেছেন, ‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।’ আর সেজন্যই ইমাম হোসাইন (রা.) দুশ্চরিত্র ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করেননি। বরং তার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’। অর্থাৎ প্রয়োজনে জীবন দেব, শহীদ হব, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করব না। ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে শাহাদতের পেয়ালা বরণ করে মুসলিম উম্মাহকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন, অত্যাচারী যেই হোক, যতই শক্তিশালী হোক তার কাছে নত হওয়া যাবে না। বরং তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।

ইমাম হোসাইন (রা.) আল্লাহতায়ালার এই বিধানকেই বাস্তবায়ন করেছিলেন। চরিত্রহীন ইয়াজিদ জোরপূর্বক খেলাফতের মসনদে চেপে বসেই ইসলামি সমাজব্যবস্থায় কুঠারাঘাত করেছিল। আল্লাহতায়ালার বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেগানা নারীতে আসক্ত হয়েছিল। অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে তাদের ওপর অত্যাচার, নীপিড়ন চালাত। ক্ষমতার চেয়ার পেয়ে ইয়াজিদ ভুলে গিয়েছিল এক আল্লাহর ইবাদত। তাকওয়া-তাহারাত। তখন আমোদণ্ডপ্রমোদে মত্ত ইয়াজিদের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে কুফার মুসলমানরা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠি লেখেন। ইসলামি হুকুমতকে ইয়াজিদের নেফাকির কবল থেকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) তাদের আহ্বানে সাড়া দেন। কেন না নবীজি বলেছেন, ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে তার ভাইয়ের প্রতি অত্যাচার করে না। আবার তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় না।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ২৪৪২)

ইমাম হোসাইন (রা.) মুসলমানদের ইয়াজিদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ঠেলে দিতে পারেননি। সেজন্যই তিনি সপরিবারে কুফার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। সেদিন যদি ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিতেন, তাহলে ইসলামকে আমরা অক্ষুণœ পেতাম? বহু আগেই তা অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। ইমাম হোসাইন (রা.) তা হতে দেননি। তিনি জানতেন কারবালায় গেলে শহীদ হবেন। চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ জাফর (রা.) যখন ইমাম হোসাইনকে মদিনায় ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি, তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি অবশ্যই সেই কাজটি করব। সেই কাজটি যে ইসলামকে পুনর্জীবিত করা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হোসাইন (রা.) শহীদ হবেন জেনেও পিছু হটেননি। বরং সপরিবারে জীবন দিয়ে নবীজির রেখে যাওয়া দীনকে রক্ষা করেছেন। নবীজি যেমন আইয়ামে জাহিলিয়াতের অত্যাচার, নিপীড়ন, কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্তির আলো দেখিয়েছেন। তেমনি ইমাম হোসাইন (রা)-ও কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে জীবন দিয়ে ইসলামকে পুনর্জীবিত করেছেন। এর পরও যারা কারবালার ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়, নবী পরিবারের ওপর মিথ্যের কালিমা লেপন করতে চায়, তারা কি আল্লাহতায়ালার এই ঘোষণা দেখে না? আল্লাহ যেখানে বলেছেন, ‘হে নবী পরিবারের সদস্যরা, আল্লাহ কেবল চান আপনাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং আপনাদের পূর্ণরূপে পূতপবিত্র রাখতে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৩)

আল্লাহ যেখানে নবী পরিবারকে পূতপবিত্র রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে এরা ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নামে মিথ্যা রটিয়ে সফল হতে পারবে? যারা ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ত্যাগকে অস্বিকার করে, নিঃসন্দেহে তারা ইয়াজিদের দোসর। এদের কারণেই মুসলমানদের মধ্যে আজ এত দ্বন্দ্ব, এত বিভক্তি। আসুন কারবালার শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে জেগে ওঠি। শুধু মহররমেই নয়, জীবনের প্রতিটি ধাপে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আদর্শকে অনুসরণ করি। তবেই না ইয়াজিদের দোসররা পরাজিত হবে। ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়বে শাশ্বত ইসলাম।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close