আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা
মুক্তমত
আমরা যদি না জাগি মা...
মানুষকে তার মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য সামর্থ্যবান করে গড়ে তোলাই ক্ষমতায়ন। ক্ষমতায়নের ধারণা মৌলিক মানবাধিকার ধারণা থেকে আলাদা করা যায় না। মানুষের ক্ষমতায়নের অন্যতম শর্ত বিচারের নাগাল পাওয়া। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান এখানে আকাশ-পাতাল। তাই দরিদ্র মানুষের অলংকার হয়েছে আমজনতা। দারিদ্র্য মানে এক অস্তিত্বের সংকট, মৌলিক চাহিদা পূরণের ন্যূনতম অবস্থা অথবা তুলনায়মূলক বঞ্চনা। অন্যের তুলনায় বস্তুগত ও সামাজিক পশ্চাৎপদতা। কোনো মানুষ নিজেকে মেলে ধরার স্বাধীনতাহীনতাই দরিদ্রতা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘দারিদ্র্য ধর্মের চেয়ে অর্ধমকে লালন করে’।
জীবন ললাট যখন রক্তে রঞ্জিত, শ্রমে জর্জরিত, আর সংগ্রামে ভেজা; তখন বিচার পদ্ধতির দহনের প্রয়োজন, যা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। মেহনতী মানুষের মুক্তি আমাদের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রাণ। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মূলধন জমির মালিকের কাছে থাকে; রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের পাশে না দাঁড়ায়, তখন কাজ হারানোর ভয়ে জমির মালিকের সঙ্গে দর-কষাকষির স্বাধীনতাটুকু হারায়। কার্ল মার্ক্স দর্শনে- শ্রমজীবী মানুষকে অধিক শোষণ করে অধিক মুনাফা লাভের মাধ্যম। রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ালেই তবে দারিদ্র্যকে জয় করা সম্ভব।
রাষ্ট্র মানুষের জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করলেও জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করছে না। বিগত এক যুগে বাংলাদেশের মানুষের আয়বৈষম্যও অনেক গুণ বাড়ছে। সম্পদের অসমতা এতটাই প্রকট যে বিশ্বে অতিধনী বাড়ার যে সংখ্যা, তাতে প্রথম বাংলাদেশ। এই আয়-বৈষম্য করোনা মহামারির কারণে শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে যেমন বাড়ছে, ঠিক তেমনি সরকারি, বেসরকারি ও এনজিওসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেও অনেক বেশি বেতন-বৈষম্য রয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো লিখেছেন, সঠিক নীতি করা হলে অসমতা নিয়ন্ত্রেণ রাখা যায়। আবার ভুলনীতির কারণে অসমতা লাগামছাড়া হয়ে যেতে পারে। সেজন্য যথাযথ নীতি প্রণয়নে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
পণ্যদ্রবের পাগলা ঘোড়া যেভাবে দৌড়াচ্ছে, তাতে দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনির পরও সীমিত আয়ের মানুষ অনেকটা দাসদের মতো জীবন পার করছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এমনকি অটোমান সাম্রাজ্যেও দাসপ্রথা ব্যাপক ছিল। ওই সময় দাসদের সঙ্গে এ সময় সীমিত আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে তাদের তুলনা করা যায়। অনেকের মতো কৃষিবিপ্লবের আগেও কোনো কোনো সমাজে দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৬০ সময়ে ব্যাবিলনে রচিত হয় ‘হামুরাবির আইন’। যারা দাসদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করত, তাদের ওই আইনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো। এখনকার দাসেরা জীবিকা নির্বাহ অনিশ্চয়তার কারণে পালিয়েও যেতে পারবে না। কারণ রাষ্ট্র কারো জীবিকা নির্বাহের দায়-দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক নয়। তাই দাসপ্রথা এখনো বিলুপ্ত হয়নি। যদিও ওই অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথা বিলুপ্তের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন অনেকে। আরব মুলুকে এ দাস প্রথাবিলুপ্ত করে ছিলেন হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন কোনো একসময় এ প্রথা যুক্তরাষ্ট্রে বিলুপ্ত করে থাকলেও এখনো সারা পৃথিবীতে দাসপ্রথা প্রচলিত আছে, তবে বিভিন্ন ফরমেটে।
বর্তমান সময়ে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাকরিজীবীরা আধুনিক দাস। স্বল্প মুজরিতে জীবন ও জীবিকার তাগিদে গার্মেন্ট ও অন্যান্য বেসরকারি চাকরি করে থাকেন। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাদের না থাকে বিনোদনের জন্য সময়, সুযোগ বা অর্থ। অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শ্রমিকদের শ্রমের সমান্য মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকের জান-মাল, ইজ্জত- সবকিছুরই যেন তারা হর্তাকর্তা হয়ে যান। আমরা জানি, পলিটিক্যাল জাস্টিস ছাড়া সোশ্যাল জাস্টিস হয় না। শ্রমিকর ঘামের দাম না দিলে সুবিচার হয় না। জনগণের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র অনেক কিছুই করে। আমরা জানি আইন আছে, কিন্তু তা প্রয়োগের অভাবে আমরা দেখতে পাই না, তবে আইনপড়া ও অনুভব করা যায় কিন্তু সহজে বোঝা যায় না। আইন এমন একটি চকচকে অথচ অপূর্ণ স্বপ্নের নাম। অনেকের কাছে এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে সুপ্ত রয়েছে, যার বিস্তারিত তাদের জানা নেই। অনেকটা মাঠের পাড়ের দূরের দেশ হিসেবে গণ্য। পথের পাঁচালির ছবির ট্রেন লাইনের ওপারের গ্রামটির মতো। আইন হলো- ন্যায় দ্বারা পৃথিবী শাসিত হওয়া, তবে মনুষ্যত্বহীনতাই আইনহীনতা।
আমরা সমাজের মানুষের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি। ন্যায়বিচার সম্পর্কে আমাদের বোধ যে অন্ধকারে আছে, সেখানে বাতি জ্বালানি ঘটেনি একেবারেই। মানুষ হিসেবে মানবজাতির সব উদ্বেগ আমাকে আচ্ছন করে। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত ও অপ্রাহারযোগ্য অধিকার। আমরা যেটা চাই তা হচ্ছে ইনসাফ, সেটা জাস্টিস থেকেও শক্তিশালী। জুডিশিয়ারি ইনসাফ বিকান না, তারা জাস্টিসের ফেরিওয়ালা বটে। কমন ‘ল’ লিগ্যাল সিস্টেম কখনো ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে না, ওই সিস্টেম শুধু জাস্টিস প্রদান করে থাকে। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব, তাই এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট
"